সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। বছরের শুরুতে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এখন সুরের আকাশে বিলীন হলেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। রবিবার সকালে মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালে ছিলেন তিনি। কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরে নিউমোনিয়া। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। শেষ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। ৮০ বছর ধরে গান গেয়েছেন প্রায় ছ হাজার। গানের ভাষার তালিকা দেখলে চমকে উঠতে হয়। মারাঠি, হিন্দি, বাংলা তো বটেই, সেইসাথে ব্রজভাষা, ছত্তিশগড়ি, ডোগরি, গাড়ওয়ালি, গুরুমুখি, গুজরাটি, কঙ্কনি, মগধি, মালায়লাম, মণিপুরী, মাড়োয়ারি, নেপালি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, রাজস্থানি, তামিল, তেলেগু, উর্দু, প্রাকৃত ও সংস্কৃত ছিল।এছাড়াও ইংরেজি, ল্যাতিন, মালয়, সিন্ধি ভাষার গানও আছে।
লতা মঙ্গেশকর এর জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। ৯২ বছর বয়সে প্রয়াণ হলেও বিশ্ববাসীর সাথে ভারতের সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের বিয়োগ বেদনা কোনও অংশে কম নয়। প্রথম যখন হিন্দি চলচ্চিত্রে গানের সুযোগের জন্য বলিউডের ব্যস্ত প্রযোজক ও পরিচালক শশধর মুখোপাধ্যায়ের কাছে যান, অতি মিহি গলার জন্য তিনি সুযোগ পাননি। সেই সময়ে সংগীত পরিচালক গোলাম হায়দার শশধরবাবুকে বলেছিলেন, একদিন আসবে বলিউডের ফিল্ম জগৎ লতার পায়ে ধরে গানের অনুরোধ করবে। তাঁর দূরদর্শিতা সত্যি বলে প্রমাণ হয়েছে।
লতার নাম ছিল হেমা। মা শিবন্তি মঙ্গেশকর। পাঁচ ভাইবোন। অন্যতম যাঁদের মধ্যে আশা ভোঁসলে, ঊষা মঙ্গেশকর। তিনি ছিলেন বড়দি। পিতা দীননাথ মঙ্গেশকরের কাছে প্রথম তামিল। স্কুলে গিয়েছিলেন জীবনে একদিন মাত্র। স্কুলে গান গাইবার জন্য শিক্ষিকার বকুনিতে আর স্কুলে যাননি। একমাত্র আরাধনা সংগীত। ১৯৪২সালে প্রথম মারাঠি ছবি কিতি হাসাল এ কণ্ঠদান করেন। এর আগে পিতার মারাঠি ছবি ভাব বন্ধন ছবিতে লতিকা নামে এক শিশুশিল্পীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এরপর পিতার ইচ্ছাতেই নাম বদল হয় লতা।
সাংবাদিক যতিন মিশ্রের লতা সুরগাঁথা নামে এক গ্রন্থে বলেন, লতাজি তাঁকে বলেছিলেন, রাজ কাপুর অনেকদিন আগেই তাঁর সত্যম শিবম সুন্দরম ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল মূল চরিত্রে যেন লতাজি অভিনয় করেন। কিন্তু লতাজি সে অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। অনেক পরে সেই ছবিতে অভিনয় করেন জিনত আমন। একবার মোহাম্মদ রফির সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় চারবছর রফির সঙ্গে গান করেননি। কারণ একবার আলোচনা হয়েছিল, গানের রয়েলটির কিছু অংশ গায়ক গায়িকার প্রাপ্য হওয়া উচিত । রফি যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন,কণ্ঠশিল্পী যখন পারিশ্রমিক পান, গানে আর অধিকার থাকে না। সেই বিষয়ে একমত হননি লতা মঙ্গেশকর। পরে অবশ্য মিটমাট হয়।
বহুদিন আগে একবার লতাজিকে হত্যার চক্রান্ত নাকি হয়েছিল। ১০দিন তিনি হাসপাতালে ছিলেন। প্রায় তিন মাস বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর প্রিয় বন্ধু তালিকায় ছিলেন দেব আনন্দ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তাঁর জীবনের দুটি আশা পূর্ণ হয়নি। এক, কে এল সায়গলের সঙ্গে সাক্ষাৎ। দুই, দিলীপকুমারের জন্য একটি গান গাওয়া। আর যে কথাটি তিনি বলতেন না, সেটা হলো তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এক ট্র্যাজিক অধ্যায়। তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সঙ্গে। কিন্তু রাজের বাড়ির আপত্তিতে সেই সম্পর্ক আর পরিণত হয়নি। এরপর আর বিয়ের কথা লতাজি ভাবেননি। সুরের দুনিয়ায় জীবন সঁপে দেন।
বাংলা ও বাঙালির সঙ্গেও ছিল তাঁর গভীর যোগাযোগ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরীর সুরে তাঁর গান বাঙালির কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় সোমবার রাজ্যে অর্ধ দিবস ছুটি ঘোষণা করেছেন লতাজির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। কেন্দ্রীয় সরকার দুদিন জাতীয় শোক দিবসের ঘোষণা করেছেন।
আজ প্রধানমন্ত্রী মুম্বাই যাচ্ছেন লতাজিকে শ্রদ্ধা জানাতে। শিল্পীর মুম্বাইস্থিত বাসস্থান প্রভু কুঞ্জে অনুরাগীরা জড়ো হচ্ছেন শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। আজ সন্ধায় শিবাজি পার্কের শ্মশানে তাঁর নশ্বর দেহ বিলীন হবে সুরালোকে। বিশ্বের সংগীতপ্রেমী মানুষ হারালো এক কিংবদন্তি শিল্পীকে।
Be First to Comment