জন্মদিনে স্মরণঃ ক বি সু ভা ষ মু খো পা ধ্যা য়
বাবলু ভট্টাচার্য : ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা’ বা ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক /আজ বসন্ত’ প্রভৃতি তার অমর পঙক্তি বাংলায় আজও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। আদর্শ তার কবিতাকে দিয়েছিল অভাবনীয় জনপ্রিয়তা। ১৯৪০-এর দশক থেকে তার অ-রোম্যান্টিক অকপট কাব্যভঙ্গী পরবর্তীকালের কবিদের কাছেও অনুসরণীয় হয়ে ওঠে।
তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও গদ্যকার।
কবিতা তার প্রধান সাহিত্যক্ষেত্র হলেও ছড়া, রিপোর্টাজ, ভ্রমণসাহিত্য, অর্থনীতিমূলক রচনা, বিদেশি গ্রন্থের অনুবাদ, কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা, উপন্যাস, জীবনী, শিশু ও কিশোর সাহিত্য সকল প্রকার রচনাতেই তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ এবং বহু দেশি-বিদেশি কবিতা বাংলায় অনুবাদও করেছেন স্বচ্ছন্দে।
কাব্যগ্রন্থ : ‘পদাতিক’, ‘অগ্নিকোণ’, ‘চিরকুট’, ‘ফুল ফুটুক’, ‘যত দূরেই যাই’, ‘কাল মধুমাস’, ‘এই ভাই’, ‘ছেলে গেছে বনে’, ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’, ‘জল সইতে’, ‘চইচই চইচই’, ‘বাঘ ডেকেছিল’, ‘যা রে কাগজের নৌকা’, ‘ধর্মের কল’।
কবিতা সংকলন : সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংগ্রহ, কবিতাসংগ্রহ-১-৪ খন্ড।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রথম থেকেই সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সমর্থক ও সক্রিয় কর্মী ছিলেন।পার্টির জন্যই তিনি নিবেদিত প্রাণ। তার কবিতায় তাই রাজনীতি প্রধান হয়ে উঠেছে যার মধ্যে আছে হৃদয়ের আবেগ ও শিল্পীর সংবেদনা। তিনি বলেছেন—
“দরদটাকে মুখের বদলে বুকের মধ্যে এবং তাৎক্ষণিকের বদলে বরাবরের করে নেবার কাব্যটাই হবে রাজনীতির সত্তা আমার কবিতার সত্তা থেকে পৃথক ছিল না”।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ থেকেই রাজনৈতিক ভাবনার বিস্ময়কর স্ফুরণ ঘটে। এই বই পড়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন— ‘বাঙালি কবির হাতেও কবিতা আর শুধু বীণা হয়ে বাজছে না, অস্ত্র হয়েও ঝলসাচ্ছে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় রোমান্টিকতার বিরোধী ছিলেন, চাঁদ-ফুল ইত্যাদিকে তিনি পরিহার করেছিলেন কারণ তা কেবল মিথ্যা মায়া নির্মাণ করে। তিনি বললেন—
“আকাশের চাঁদ দেয় বুঝি হাতছানি?
ওসব কেবল বুর্জোয়াদের মায়া-
আমরা তো নই প্রজাপতি- সন্ধানী!
অন্তত, আজ মাড়াই না তার ছায়া।”
কিন্তু রোমান্স তো হারায় না, তা মিশে থাকে মেহনতী মানুষের জীবনচর্যায় তার কান্না-ঘাম-রক্তের সঙ্গে—
“চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে।”
[মে দিনের কবিতা/ পদাতিক]
অন্নাভাব দুর্ভিক্ষ মন্বন্তর কবিকে ব্যথিত ক্রুদ্ধ করেছে। তিনি আগুনঝরা কণ্ঠে বললেন—
“পেট জ্বলছে, ক্ষেত জ্বলছে
হুজুর, জেনে রাখুন
খাজনা এবার মাপ না হলে
জ্বলে উঠবে আগুন”
[চিরকুট/ চিরকুট]
কবি প্রেমকে অস্বীকার করেন নি। তবে এই প্রেম নর-নারীর দেহনির্ভর নয়, নিছক রোমান্টিক কল্পনা বিলাসও নয়। এই প্রেমে আছে ঝড়ের মাতন, আগুনের দাহ, নিষিদ্ধ ইস্তাহারের বিপ্লব বার্তা। তাই মিছিলের একটি মুখ কবিকে উজ্জীবিত করে যায় নিষ্কোষিত তরবারির দীপ্তিতে অন্যায় পাপকে নির্মূল করে আর-
“সমস্ত পৃথিবীর শৃঙ্খলমুক্ত ভালবাসা/দুটি হৃদয়ের সেতুপথে/পারাপার করতে পারে।”
[মিছিলের মুখ/ অগ্নিকোণ]
রূপদক্ষ শিল্পীর নির্মাণ-কৌশলের পরিচয় বহন করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা।
পার্টির প্রতি আনুগত্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিষ্ঠাবান করেছে। সংগ্রামী ভাবনায় উদ্দীপিত করেছে। সর্বহারার মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় প্রণোদিত করেছে। কিন্তু আদর্শচ্যুতি কবি মেনে নেন নি। তার বিশ্বাসের ভিত্তি শিথিল হওয়ায় তিনি সংগ্রামের পথ থেকে যেন দূরে সরে এসেছেন।
তবু ক্লান্ত বিষণ্ণ পরিবেশে, মলিন মুমূর্যু শহরে, দুঃস্বপ্নের নগরী কলকাতায় লাল নিশান নিয়ে একদল মজুরের এক বিশাল মিছিল দেখে ধর্মতলায় ট্রাম ওমটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লেনিন চিৎকার করে বললেন—
“শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে –
একটু পা চালিয়ে, ভাই, একটু পা চালিয়ে”
[একটু পা চালিয়ে ভাই]
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বঞ্চনা ও অসম্মান অনেক জুটলেও সাহিত্যের অঙ্গনে সম্মানিতই হয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার পান ১৯৬৪ সালে। ১৯৭৭ সালে অ্যাফ্রো- এশিয়ান লোটাস প্রাইজ। ১৯৮২ সালে কুমারন আসান পুরস্কার; ১৯৮২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রদত্ত মির্জো টারসান জেড পুরস্কার।
১৯৮৪ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ওই বছরেই পান সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু পুরস্কার ও ১৯৯২ সালে ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। ১৯৯৬ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা সাহিত্য অকাদেমী ফেলোশিপ পান সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানিত করেছিল তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম দ্বারা।
২০১০ সালের ৭ অক্টোবর কলকাতা মেট্রো নিউ গড়িয়া স্টেশনটি কবির নামে উৎসর্গ করে। এই স্টেশনটি বর্তমানে ‘কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন’ নামে পরিচিত।
যকৃৎ ও হৃদপিণ্ডের অসুস্থতার কারণে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর ২০০৩ সালের ৮ জুলাই কলকাতায় তার প্রয়াণ ঘটে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯১৯সালের আজকের দিনে (১২ফেব্রু) পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment