Press "Enter" to skip to content

সুপ্রিয়াদেবীর অভিনয় মানেই “দাদা আমি বাঁচতে চাই…” সন্দেহ নেই, শ্রেষ্ঠ অভিনয়। সমস্ত সত্তা নিংড়ানো সেই হাহাকারে গায়ে কাঁটা দেয় আজও। কথা নয়, ডায়লগ নয়, ওই হাহাকারই সুপ্রিয়াদেবী……….।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ সুপ্রিয়া দেবী

বাবলু ভট্টাচার্য : বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে বিশাল ভরভরতি সংসার। নামজাদা অ্যাডভোকেট বাবার দু’হাতে রোজগার। কাকা ডা. সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের ক্যাবিনেট মিনিস্টার। বড় জামাইবাবু সাহিত্যিক বনফুল— নিটোল সম্ভ্রান্ত পরিবার।

বাইরের পৃথিবীতে তখন যুদ্ধের দামামা। বর্মার বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়ি, বাবার অত বড় প্র্যাকটিস, সব ছেড়েছুড়ে সেই বাঁচার তাড়নায়, টিকে থাকার তাগিদে, কখনও নৌকায়, তারপর পায়ে হেঁটে দু’মাস ধরে হাঁটাপথে পথ চলে কলকাতায় পালিয়ে আসা।… বয়স তখন কত? দশ কী এগারো! কলকাতায় এসে ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি।

বড় দিদিদের বিয়ে দিতে গিয়ে বাবার হাত শূন্য। সেই রকম এক সময়ে চন্দ্রাবতীদেবীর সান্নিধ্য, আর সিনেমায় আসা। চন্দ্রাবতী দেবীর একই পাড়ায় পাশের বাড়িতে উঠেছিল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার।

ছবির নাম ‘নাগপাশ’। অসিতবরণ নায়ক, কিন্তু মুক্তি পায়নি সেই ছবি।

বাধা দিয়েছিলেন বড় জামাইবাবু সাহিত্যিক বনফুল। চোদ্দো-পনেরো বছরের মেয়ে তখন কোমর বেঁধে তাঁর বাড়ি গিয়ে বলে এসেছিল- ‘আপনি আপনার বই সিনেমা হওয়ার জন্য দিতে পারেন, আর আমি সিনেমা করলেই যত দোষ?’ এর মধ্যেই এল দ্বিতীয় ছবির ডাক— ‘বসু পরিবার’। এমপি প্রোডাকশনসের ব্যানারে। এখানেই ‘সুপ্রিয়া’-তে রূপান্তরিত হন বেণু বন্দ্যোপাধ্যায়।

এর পর থেকে নায়িকার রোল— ‘শুন বরনারী’। আর নায়ক? উত্তমকুমার। চলছে পর পর ছবি করা। বলতে গেলে সেই টাকাতেই বিয়ে হয়ে গেল ঠিক উপরের বোন ছোড়দির।

এ বার শুরু হল সব চেয়ে ছোট মেয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ। বেণু প্রায়ই শ্যুটিং শেষে বাড়ি ফিরে দেখত তার দুর্দান্ত সুপুরুষ বাবা শৌখিন লাঠি হাতে ঘেমেনেয়ে টকটকে লাল হয়ে বিমর্ষ মুখে মাকে বলছেন- ‘পাঁচ হাজার ছ’হাজার টাকা পণ হাঁকছে সব। কী যে করি, কোথায় পাই…!’

অসাধারণ রূপবান, ব্যক্তিত্বময় বাবার এই অসহায়তা সহ্য হচ্ছিল না বেণু ওরফে সুপ্রিয়া দেবীর। তখনই ঘটল সেই অভাবনীয় ঘটনা।

পার্কসার্কাসে প্রায়ই যেত আরেক দিদির বাড়ি। সেখানে অফিস ক্লাবের থিয়েটারের মহড়া চলত। একদিন পার্ক সার্কাসে দিদির বাড়ি। সাহেবের মতো ফর্সা, লম্বা অতি সুদর্শন এক যুবাপুরুষ বাইরের ঘরে বসা। সে’ও একদৃষ্টিতে দেখছিল ছিপছিপে শ্যামাঙ্গী সুদর্শনাকে। বেণু শুনতে পেল দিদিকে জিজ্ঞেস করছে- ‘মেয়েটি কে?’

তার বোন শুনে ফের রসিকতা করে বলেছিল- ‘আমার সঙ্গে বিয়ে দেবে?’ নিছকই মজা। কিন্তু! দিদির কাছ থেকে ছেলেটির অফিস, কনট্যাক্ট নম্বর ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য জোগাড় করে চুপচাপ চলে এল বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির টাকার জন্য বিয়ে না-হওয়া ছোট মেয়ে।

গড়িয়াহাটের ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের দোকান থেকে সোজা ফোন করল কনট্যাক্ট নম্বরে।

ও প্রান্তে ছেলেটির গলা পেতেই প্রথম বোমাটা ফাটাল- ‘আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?’ ওদিক থেকে হতভম্ব প্রশ্ন- ‘কে? আপনি কে!’

এদিক থেকে স্থির স্বরে- ‘আমি দীপ্তিদির বোন। পার্কসার্কাসে যার বাড়িতে আপনি আমাকে দেখে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি। আপনি করবেন আমায় বিয়ে?’

ওদিক থেকে প্রচণ্ড থতমত গলায়- ‘আমি… আমি একটু ভেবে দেখি… তা ছাড়া আমার মা রয়েছেন। তাঁরও মত নিতে হবে।’

বেণু তথা সুপ্রিয়া বললেন- ‘ভাবুন। মায়ের মত নিন। আমি পরে আবার ফোন করব।’

ফোন রেখে বাড়ি। কাউকে একটি কথাও জানাল না। এই সুদর্শন ছেলেটিই বিশ্বনাথ চৌধুরী। বেণু বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুপ্রিয়ার প্রথম স্বামী। সে নয়, আঠারো বছরের মেয়েই বিয়ে করে ছাড়ল তাকে, বাবাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে। একেবারে রেজিস্ট্রি করেই বাড়ি এসে ঢুকল।

তখন রাস্তায় সন্ধ্যের আলো জ্বলে গেছে। সময় পেরিয়ে গেছে বাড়ি ফেরার। রাশভারী বাবা রেগে টকটকে লাল হয়ে হাতের লাঠি উঁচিয়ে- ‘কোথায় ছিলে এত ক্ষণ?’

ছোট মেয়ে অকম্পিত গলায়- ‘লাঠি নামান। আপনি আমায় মারতে পারেন না। আমি বিবাহিত মেয়ে। রেজিস্ট্রি করে এসেছি।’

ঘটনার আকস্মিকতায়, ধাক্কায় সবাই প্রথমে বজ্রাহত। পরে মেনে নেওয়া, হিন্দুমতে বিয়ে, সবই করা হল।

প্রথম বিয়েতে সুপ্রিয়া চৌধুরী তার স্বামীর কাছ থেকে একটিই ইতিবাচক জিনিস পেয়েছিল— সন্তান— ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে, সোমা। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও টেকেনি এ বিয়ে।

তখন যথেষ্ট নাম, যথেষ্ট রোজগার, একমাত্র মেয়েকে নামকরা বোর্ডিং স্কুলে রেখে পড়ানো। কিন্তু এতটুকু স্বস্তি নেই, শান্তি নেই নিজের ঘরে। যার ফলে মাঝেমাঝেই হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ি থেকে ‘স্পেনসর্স’ হোটেলে পালিয়ে গিয়ে একা থাকা।

সেই দিনে সেই সময়ে এটা কম কথা নয়। কম সাহসের কাজ নয়। উত্তমকুমারের সঙ্গে তখন সম্পর্ক শুধুই সহকর্মীর, সহজ বন্ধুত্বের। যাক, প্রথম বিয়ে তো ভাঙল।
বিশ্বনাথ চৌধুরী চলে গেলেন দিল্লি। ফের বিয়েও করলেন ডিভোর্স না করেই এবং করলেনও প্রথম স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেই- ‘আমি কি বিয়ে করতে পারি?’

স্বামীকে এক কথায় ছাড় দিয়েছিল। বলেছিল- ‘নিশ্চয়ই।’ পরে ফর্মাল ডিভোর্স। ময়রা স্ট্রিট-এ বিশাল ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে, সব দিক থেকে নিজের সামর্থ্যে নিজের সঙ্গে একা থাকা শুরু হল সুপ্রিয়া দেবী’র।

এর পর জীবনের দ্বিতীয় ভাগ। যেখানে প্রবেশ উত্তমকুমারের।

অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী এমনই বিলীন হয়ে কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন, নিজের পূর্ণ বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময়টা ‘উত্তম-প্রেমে’, যে তার ‘আমি’ বলে আর কিছু রইল না। যে ‘আমি’র মধ্যে আরও অনেক অনেক সম্ভাবনা ছিল। বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল। দুর্দান্ত ন্যাচারাল অ্যাক্টিং-এর ক্ষমতা ছিল। ক্লাসিক্যাল নৃত্যকলা ছিল। মুম্বই থেকে তখনকার টপ হিরোদের সঙ্গে কাস্ট হওয়ার ডাক ছিল। কিন্তু হল না।

সব কিছু থাকা সত্ত্বেও উত্তমকুমারের প্রখর দীপ্তির ‘রিফ্লেক্টেড গ্লোরি’তে আচ্ছন্ন, ‘চাঁদের আলো’ হয়ে থাকাই বেছে নিল অসামান্য ক্ষমতার অভিনেত্রী সুপ্রিয়াদেবী।
বহু কাল আগে শক্তিপদ রাজগুরুর গল্প ‘চেনা মুখ’ পড়তে পড়তে পাশে ঘুমন্ত স্বামী বিশ্বনাথ চৌধুরীকে জাগিয়ে তুলে সুপ্রিয়া চৌধুরী অনুনয় করেছিলেন, “যদি কেউ কোনও দিন এই বইটা নিয়ে ছবি করে আর আমাকে ‘নীতা’ করতে দেয়, তাহলে তুমি টাকা-পয়সা নিয়ে একটা কথাও বোলো না”— অদ্ভুতভাবে পরদিনই বিকেলে তাদের হিন্দুস্তান রোডের বাড়ির সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ঋত্বিক ঘটক।

সুপ্রিয়া চৌধুরী তখনও শ্যুটিং থেকে বাড়ি ফেরেননি। তাঁকে দেখামাত্র বাঙাল ভাষায় বিচিত্র সম্বোধনে ঋত্বিক ঘটক বলে উঠেছিলেন- ‘অ্যাই ছেমড়ি, একটা ছবি করতাসি ‘চেনা মুখ’ গল্প নিয়া। তর লিগা একটা পার্ট আসে— ‘নীতা’। সব কাম প্যাক-আপ কইরা দশ দিনের লিগা শিলং চল…’ নিজের চোখকানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সুপ্রিয়া। পরেরটা তো ইতিহাস। সবাই জানে। এখনও, এই আশি বছর পার করেও, সুপ্রিয়াদেবী মানেই ‘মেঘে ঢাকা তারা’।

সুপ্রিয়াদেবীর অভিনয় মানেই “দাদা আমি বাঁচতে চাই…” সন্দেহ নেই, শ্রেষ্ঠ অভিনয়। সমস্ত সত্তা নিংড়ানো সেই হাহাকারে গায়ে কাঁটা দেয় আজও। কথা নয়, ডায়লগ নয়, ওই হাহাকারই সুপ্রিয়াদেবী।

এত কিছু সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সুপ্রিয়া দেবী আক্ষরিক ভাবেই মেঘে ঢাকা তারা হয়ে থেকে গেল তার গোটা জীবনটায়। স্বেচ্ছায়, আত্মপীড়নে, নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে, নিজের সঙ্গে নিজে যুঝতে যুঝতে।

সুপ্রিয়া (চৌধুরী) দেবী ১৯৩৩ সালের আজকের দিনে (৮ জানুয়ারি) বর্মায় জন্মগ্রহণ করেন।

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.