জন্মদিনে স্মরণঃ সুচিত্রা মিত্র
বাবলু ভট্টাচার্য : সুচিত্রা মিত্র— শুধু একটি নামই নয়, একটি ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথের গান সবাই গান, কিন্তু এমনভাবে তা নিজের জীবনেও অনুসরণ করতে পারেন ক’জন? তাঁর জীবন সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দায়িত হয়ে বয়ে চলেছে এতটা কাল। তাঁর বাবা সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন লেখক, পেশায় উকিল। তাঁর জন্ম হয়েছিল চলন্ত ট্রেনে, তাই তিনি প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতেন, আমি তো জন্ম থেকে যাযাবর। দারুণ সংস্কৃতিমনা পরিবার থেকে উঠে আসা বলে তাঁর পরবর্তী জীবন ধারায় তার প্রভাব দেখা যায়। বাবা উকিল হলেও পেশায় যত না মন, তার চেয়ে সাহিত্যে মনোযোগ বেশি। ফলে, অভাব তাঁর খুব অপরিচিত কিছু ছিল না।
ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালবাসা। একবার শুনলেই কোন গান শিখে ফেলেন আর তারপর গলা ফাটিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বেড়ানো— এই স্বভাবের সুচিত্রা যে পরের সময়টা গান শুনিয়েই কাটিয়ে দেবেন, তা কি খুব অমূলক মনে হয়? তাঁর বড়বোনের বান্ধবী উমা স্নেহানবীশ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ হলে কবিগুরুর স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে। কবি তখন সদ্য প্রয়াত। গান গাওয়ার কোনও যন্ত্রপাতি নেই। তার মাঝেই ছোট সুচিত্রা খালি গলায় গেয়ে উঠলেন— ‘যখন পড়বে না মোর পয়ের চিহ্ন এই বাটে’… গানটি সবার খুব মনে ধরেছিল। তারপর সুচিত্রা বৃত্তি নিয়ে সংগীতভবনে ভর্ত্তি হলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র ২০ দিন পর।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগেই সংগীতভবনে ছাত্রসংখ্যা কমে গিয়েছিল। শৈলজারঞ্জন মজুমদার গুরুদেবকে বললেন, একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। তিনি সম্মত হলেন। শৈলজারঞ্জন তার পরিচিত মহলকে গুণীর সন্ধান করতে বললেন। তখন বিজয়া দাস তাকে জানান, তাদের স্কুলের ক্লাস টেনের একটি মেয়ে খুব ভাল গায়। সাথে সাথে বৃত্তি মঞ্জুর হয়ে গেল। বাবার আপত্তি সত্বেও দিদিদের উৎসাহে সুচিত্রা গেলেন গান শিখতে শান্তিনিকেতনে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বোলপুর তখন কিছুটা শূন্য মনে হলেও সংগীতভবন মোটেও তারকাশূন্য নয়। ছাত্রদের মধ্যে কণিকা বন্দোপাধ্যায়, অরুন্ধুতী গুহঠাকুরতা, কমলা সেন (বসু), চিত্রা মজুমদার, অশোকতরু— এরকম সব ছাত্র। আর শিক্ষকদের নামও কম ভারী নয়, শৈলজারঞ্জন তো ছিলেনই মাথা হয়ে। আরও ছিলেন ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভিভি ওয়াঝেলওয়ার প্রমুখ।কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন— ‘কীরকম ঝরঝরে চেহারা, টরটরে কথাবার্তা, কী স্মার্ট চলাফেরা— আমরা অবাক হয়ে সুচিত্রাকে দেখতুম। তখন সুচিত্রার সাথে কিছুটা সমান তালে পাল্লা দিতে চেষ্টা করত অরুন্ধতী। কিন্তু ঠোক্করও খেতেন।’
সঙ্গীতভবন থেকে বের হওয়ার বছরেই তার প্রথম রেকর্ড বেরোয়। তাঁর একদিকে ছিল— ‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান।’ অন্য পিঠে— ‘হৃদয়ের একূল ওকূল।’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেইকালেও প্রথম রেকর্ডে অপরিমেয় সাফল্যলাভ! সেই কারণে সম্মেলক কন্ঠে ছাড়াও দেখা যাচ্ছে, তাঁর ’৪৭ এ দু’টি, ’৪৮ এ তিনটি, ’৪৯ এ তিনটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে এমন গানও আছে, যার সাথে সুচিত্রার নাম চিরদিন জড়িয়ে থাকবে— ‘সার্থক জনম আমার’, ‘নৃত্যের তালে তালে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে’, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে’ ইত্যাদি।
সুচিত্রা সংসার জীবনে সুখী হতে পারেননি। ধ্রুব মিত্র সুভদ্র হলেও দায়িত্ববোধের অভাব ছিল। ফলে, সংসারের খরচ অনেকটাই সুচিত্রাকে যোগাড় করতে হত। ধ্রুব আবার তার স্বাধীনচেতা স্বভাবও মেনে নিতে পারেন নি। ফলে একসময় আলাদা হয়ে বাস করতে শুরু করলেন তিনি।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের একটা বিভাগ খুলেছিলেন— যার প্রধান ছিলেন ১৯৮৪ পর্যন্ত। তাঁর অসামান্য কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭৪ সালে পদ্মশ্রী, পরবর্তীতে দেশিকোত্তম ও এইচএমভি’র গোল্ডেন ডিস্ক এওয়ার্ড পান।
ঋতুপর্ণ ঘোষ নির্মিত ছবি ‘দহন’ এ অসাধারণ অভিনয় করেন সুচিত্রা মিত্র।
সুচিত্রা মিত্র ১৯২৪ সালের আজকের দিনে (১৯ সেপ্টেম্বর) বিহারের গুঝান্টিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment