জন্মদিনে স্মরণঃ সু চি ত্রা মি ত্র
“কী রকম ঝরঝরে চেহারা, টরটরে কথাবার্তা, কী স্মার্ট চলাফেরা— আমরা অবাক হয়ে সুচিত্রাকে দেখতুম।”
[ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ]
বাবলু ভট্টাচার্য : ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’- গেয়ে তখন তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন অনেক। বিদগ্ধ-মহলে ‘কৃষ্ণকলি’ মানেই তখন তাঁর নাম। তাঁর কণ্ঠ ছাড়া এই গান অন্য কারো গলায় শুনতে তখন অনেকেই ইতস্তত করেন।
তিনি সুচিত্রা মিত্র।
তাঁর পিতা রামায়ণ-অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস ওঝা’র উত্তর পুরুষ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক। মায়ের নাম সুবর্ণলতা দেবী।
সুচিত্রা মিত্রের জন্ম হয়েছিল চলন্ত ট্রেনে, তাই তিনি প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতেন, আমি তো জন্ম থেকে যাযাবর। দারুণ সংস্কৃতিমনা পরিবার থেকে উঠে আসা বলে তাঁর পরবর্তী জীবন ধারায় তার প্রভাব দেখা যায়। বাবা উকিল হলেও পেশায় যত না মন, তার চেয়ে সাহিত্যে মনোযোগ বেশি। ফলে, অভাব তাঁর খুব অপরিচিত কিছু ছিল না।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগেই সংগীতভবনে ছাত্রসংখ্যা কমে গিয়েছিল। শৈলজারঞ্জন মজুমদার গুরুদেবকে বললেন, একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। তিনি সম্মত হলেন। সুচিত্রা বৃত্তি নিয়ে সংগীতভবনে ভর্ত্তি হলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র ২০ দিন পর।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বোলপুর তখন কিছুটা শূন্য মনে হলেও সংগীতভবন মোটেও তারকাশূন্য নয়। ছাত্রদের মধ্যে কণিকা বন্দোপাধ্যায়, অরুন্ধতী গুহঠাকুরতা, কমলা সেন (বসু), চিত্রা মজুমদার, অশোকতরু— এরকম সব ছাত্র।
শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন শৈলজারঞ্জন তো ছিলেনই মাথা হয়ে। আরও ছিলেন ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভিভি ওয়াঝেলওয়ার প্রমুখ।
সঙ্গীতভবন থেকে বের হওয়ার বছরেই তাঁর প্রথম রেকর্ড বেরোয়। তার একদিকে ছিল— ‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান।’ অন্য পিঠে— ‘হৃদয়ের একূল ওকূল।’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেইকালেও প্রথম রেকর্ডে অপরিমেয় সাফল্যলাভ! সেই কারণে সম্মেলক কন্ঠে ছাড়াও দেখা যাচ্ছে, তাঁর ’৪৭ এ দু’টি, ’৪৮ এ তিনটি, ’৪৯ এ তিনটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
এরমধ্যে এমন গানও আছে, যার সাথে সুচিত্রার নাম চিরদিন জড়িয়ে থাকবে— ‘সার্থক জনম আমার’, ‘নৃত্যের তালে তালে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে’, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে’ ইত্যাদি।
সুচিত্রা সংসার জীবনে সুখী হতে পারেননি। ধ্রুব মিত্র সুভদ্র হলেও দায়িত্ববোধের অভাব ছিল। ফলে, সংসারের খরচ অনেকটাই সুচিত্রাকে যোগাড় করতে হত। ধ্রুব আবার তাঁর স্বাধীনচেতা স্বভাবও মেনে নিতে পারেন নি। ফলে একসময় আলাদা হয়ে বাস করতে শুরু করলেন তিনি।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা বিভাগ খুলেছিলেন— যার প্রধান ছিলেন ১৯৮৪ পর্যন্ত। তাঁর অসামান্য কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭৪ সালে পদ্মশ্রী, পরবর্তীতে দেশিকোত্তম ও এইচএমভি’র গোল্ডেন ডিস্ক এওয়ার্ড পান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে জুলাই মাসে কলকাতার রাজপথে সেখানকার বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা যে মিছিল বের করে তার অগ্রভাগে ছিলেন সুচিত্রা মিত্র।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতীয় সঙ্গীতসহ দেশপ্রেমের গান গেয়ে বাংলাদেশের শিল্পীদের সাথে পথে পথে ঘুরে শরণার্থীদের তহবিল সংগ্রহের জন্যও বহু অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ বন্যার সময় সব শিল্পীদের নিয়ে কলকাতা শহরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। সেই অর্থ বাংলাদেশে এসে বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে সাহায্যে করে গেছেন।
১৯৭৩ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে।
২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সুচিত্রা মিত্র মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
ঋতুপর্ণ ঘোষ নির্মিত ‘দহন’ চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা মিত্র।
সুচিত্রা মিত্র ১৯২৪ সালের আজকের দিনে (১৯ সেপ্টেম্বর) বিহারের গুঝান্টিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment