জন্মদিনে স্মরণঃ দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়
বাবলু ভট্টাচার্য : যে কোনও মাধ্যমেই অভিনেতা দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের সাদর প্রশংসা পেয়েছিলেন তাঁর সহজ অভিনয় শৈলীর কারণে। তাঁর চরিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল চরিত্রের ‘ভিতরের মানুষটিকে’ আবিষ্কার করা। এই আবিষ্কার প্রক্রিয়ায় দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় মগ্ন মননশীল প্রয়াসে সাবলীলভাবে প্রবেশ করে যেতেন চরিত্রটির সত্তার অন্তরমহলে। ব্যক্তিগত প্রবণতাগুলি অতিক্রম করে তিনি আয়ত্ত করে নিতেন চরিত্রের যথাযথ এবং মানানসই বৈশিষ্ট্য বা ঝোঁকগুলি। ফলত তাঁর অভিনীত চরিত্ররা অবলীলায় দর্শকের দেখাশোনার অভিজ্ঞতার সহচর হয়ে যেত। অভিনেতার পৃথক অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয়ে দর্শকের কাছে অভিনেতা দ্বিজেনবাবু এবং তাঁর অভিনীত চরিত্র হয়ে উঠতো সহজ। এমনই সহজ অভিনয়ের গুণে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট সেইসব চরিত্ররা দর্শকের স্মৃতিতে ‘ভালোবাসার মানুষ’ রূপেই থেকে যাবে।১৯৭২ সালে সুব্রত নন্দী নির্দেশিত থিয়েটার ফ্রন্ট-এর প্রযোজনা ‘বাগবন্দী’-তে দ্বিজেনবাবুর প্রথম মঞ্চাভিনয়। ক্রমশ তিনি ‘থিয়েটার কমিউন’ নাট্যদলে নীলকণ্ঠ সেনগুপ্তর পরিচালনায় অভিনয় করেন ‘কিং কিং’ এবং ‘দানসাগর’ নাটকে।
শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ‘গালিলেওর জীবন’ এবং ‘দশচক্র’ প্রযোজনায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা যায় তাঁকে। অসিত মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় অভিনয় করেন ‘কুমারসম্ভব’, ‘ঘোড়া’, ‘ভস্ম’, ‘নীলাম নীলাম’ প্রভৃতি নাটকে। ‘শূদ্রক’ প্রযোজনা ‘অমিতাক্ষর’ নাটকে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় যেমন বহুলভাবে প্রশংসিত হয়েছিল একইসঙ্গে দ্বিজেনবাবু অভিনয়ের একটি বিশিষ্ট ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই প্রযোজনার মাধ্যমে। সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘সাদা ঘোড়া’ বা বিভাস চক্রবর্তী পরিচালিত ‘বলিদান’, ‘গিরগিটি’, ‘গাজিসাহেবের কিসসা’ প্রভৃতি নাটকে দ্বিজেনবাবু তাঁর অভিনয় দক্ষতার প্রদর্শনে দর্শককে উদ্বেল করেছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘প্রাণতপস্যা’, ‘কুরবানি’, ‘আরোহণ’, ‘তৃতীয় অঙ্ক, অতএব’, ‘ছাড়িগঙ্গা’ প্রভৃতি প্রযোজনায় দ্বিজেনবাবুর অভিনয় দর্শকের মানে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে থাকবে।
দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজের নাট্যসংগঠন ‘সংস্তব’-এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৮২ সালে। এই দলের ১৯৯৩ সালের প্রযোজনা ‘মুষ্ঠিযোগ’ বাংলা রঙ্গমঞ্চে ইতিহাস তৈরি করে। ‘মুষ্ঠিযোগ’-এর নাটককার মোহিত চট্টোপাধ্যায় এবং দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়-এই জাদুকর জুটি পেয়েছিল বাংলা থিয়েটার। যার শুরু ‘সুন্দর’-এ; ক্রমান্বয়ে এসেছে ‘মুষ্ঠিযোগ’, ‘তুষাগ্নি’, ‘অক্টোপাস লিমিটেড’, ‘এই ঘুম’, ‘ভূতনাথ’ প্রভৃতি। দ্বিজেনবাবুর নির্দেশিত সর্বেশষ পূর্ণাঙ্গ এবং একাঙ্ক প্রযোজনা দুটিরই নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়। প্রথমটি একুশ শতক-এর প্রযোজনা ‘নিষাদ’ আর দ্বিতীয়টি ‘বর্ণপরিচয়’ সংস্তব অভিনয় করে অন্য থিয়েটার আয়োজিত নাট্যস্বপ্নকলা- ২০১৫-য়। নাট্যজগতে অভিনেতা এবং পরিচালকরূপে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় চার দশকেরও বেশি সময় মানুষকে মোহিত করে রেখেছিলেন। নাট্যের পাশাপাশি ধারাবাহিক এবং চলচ্চিত্রেও তাঁর মেধাবী উপস্থিতি ছিল। ‘আবার যখের ধন’, ‘চুনিপান্না’, ‘দত্ত বাড়ির ছোট বৌ’ কিংবা ‘লাবণ্যের সংসার’ প্রভৃতি ধারাবাহিকে অভিনয়ে তিনি দর্শকের কাছে হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয়।
আবার তরুণ মজুমদারের ‘ভালোবাসার বাড়ি’, ‘চাঁদের বাড়ি’; সন্দীপ রায়ের ‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘যেখানে ভূতের ভয়’, ‘বাদশাহী আংটি’, অভিজিৎ গুহ ও সুদেষ্ণা রায়ের ‘বেঁচে থাকার গান’, শৈবাল মিত্রের ‘শজারুর কাঁটা’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘অটোগ্রাফ’ এবং ‘জাতিস্মর’-এ দ্বিজেনবাবুর মননশীল অভিনয় তাঁকে করে তুলেছিল ‘দর্শকের ভালোবাসার মানুষ’।
মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রের দর্শককুলের ‘ভালবাসার মানুষ’ দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৯ সালের আজকের দিনে (২২ সেপ্টেম্বর) জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment