—————–স্মরণ : সলিল চৌধুরী—————
বাবলু ভট্টাচার্য : আধুনিক বাংলা গানের নতুন ধারার প্রবর্তন হয়েছে তাঁরই হাত ধরে। তাঁর কবিতা ও অসামান্য সুর কথা বলে উঠেছে প্রবল আহ্বানে; যা গণমানুষের হৃদয়ের কথা। তিনি সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ সলিল চৌধুরী। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুরের মিশেলে, ঘন স্ট্রিংস আর বাঁশির বুনিয়াদে সঙ্গীতের প্রাসাদ গড়েছেন সলিল চৌধুরী। যে প্রাসাদ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিপ্লব-সংহতি এবং শান্তির প্রতীকী বহন করে।১৯২৩ সালের ১৯ নভেম্বর সলিল চৌধুরী আসামের রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের গাজিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী, আসামের লতাবাড়ি চা বাগানে ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। বাবার কাছেই সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি। নিখিল চৌধুরীর কাছেও তিনি সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন। সলিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুভাষগ্রামে, (পুরাতন নাম কোদালিয়া) মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি পিতার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন। তাঁর পিতা চা বাগানের কুলি এবং স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের সাথে মঞ্চ নাটক করে সুখ্যাতি অর্জন করেন।হারিনাভি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং উচ্চ মাধ্যমিক (আইএসসি) পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এ সময়েই সঙ্গীত জ্ঞানে পরিপক্বতা লাভের পাশাপাশি দ্রুত তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জন্মায়।

সে সময় তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন)-এ যোগ দেন। তখনই গান লিখতে ও সুর করতে শুরু করেন সলিল চৌধুরী।সেসময় আইপিটি-এর সাংস্কৃতিক দলটি বিভিন্ন শহর ও গ্রামগঞ্জে ভ্রমণ করতে থাকে। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে ‘বিচারপতি’, ‘রানার’ এবং ‘অবাক পৃথিবী’র মতো গান। যা তখন সাধারণ জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর ‘গাঁয়ের বধূ’র মতো গান বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছিল, যা মাত্র ২০ বছর বয়সে সুর করেছিলেন সলিল। পশ্চিমবঙ্গে তখনকার প্রায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এসব গান গেয়েছেন। এরমধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বাংলা গানে নতুন দিগন্ত নিয়ে এসেছিল তাঁর গণসঙ্গীত! তিনি ছিলেন সুরের জাদুকর। পঞ্চাশের মন্বন্তরে সলিল সৃষ্টি করলেন একের পর এক গান, ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’, ‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’। তাঁর লেখা গণসঙ্গীত অনুপ্রাণিত করতে থাকে ছাত্র-মজুর-কৃষকসহ সব অধিকার বঞ্চিতদের। গণসঙ্গীতের সর্বজনীন আবেদন বারবার এসেছে তাঁর গানের কথা আর সুরের মূর্ছনায়।

চলচ্চিত্রেও তিনি রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। তাঁর প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘পরিবর্তন’ মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। ১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত ‘দো বিঘা জমিন’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল চৌধুরী ১৯৬৪ সালে ‘চিম্মিন’ দিয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। চলচ্চিত্র সফলতা পাক বা না পাক সলিলের মালয়ালাম গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।তিনি প্রায় ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্র, প্রায় ২৬টি মালয়ালাম চলচ্চিত্র এবং বেশ কিছু মারাঠি, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তাঁর ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল ‘মহাভারতী’ যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। সলিল চৌধুরীর ছোটগল্প ‘রিকশাওয়ালা’ অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রটি তাঁর কর্মজীবনকে নতুন মাত্রা যোগ করে, যখন এটি প্রথমে ফিল্মফেয়ার সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়। ব্যক্তিগত জীবনে সলিল চৌধুরী বিয়ে করেছিলেন সবিতা চৌধুরীকে। তাঁদের দুই কন্যা এবং এক পুত্র রয়েছে। তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল নানা ধারায়। একাধারে তিনি একজন সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, কবি ও গল্পকার। তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। আধুনিক বাংলা গানের সুরস্রষ্টা হিসেবে এবং গণসঙ্গীতের প্রণেতা হিসেবে তিনি একজন স্মরণীয় বাঙালি।

সলিল চৌধুরী ১৯৯৫ সালের আজকের দিনে (৫ সেপ্টেম্বর) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment