Press "Enter" to skip to content

সরস্বতী পুজো মানেই শুধু রোদ-রঙা হলুদ শাড়ি নয়, অনেকেরই প্রথম শাড়ি পরে শিহরিত হবার দিন। এমন কি সরস্বতী পুজো আমাদের সময়কার মেয়েদের জীবনেও ছিল প্রথম স্বাধীনতা দিবস। মেয়ে পটানোয় আমার অবস্থা খুব সুবিধের ছিল না। কিন্তু যারা মেয়ে তোলার ঠিক তুলত…….।

Spread the love

আমার গদ্যঃ সরস্বতী পুজো ছিল আমাদের ভ্যালেন্টাইন ডে —

বাবলু ভট্টাচার্য : ‘বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে’…
একহাতে বইপত্র, ওপর হাতে গান-বাজনার চর্চার দায় নিয়েছেন যিনি, তিনি ‘গডেস অব উইসডম’— দেবী সরস্বতী। তাই তো পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে দেবীর পায়ে গচ্ছিত থাকে গানের স্বরলিপি খাতাও। পুজোর পরদিন বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে চেপ্টে থাকে গাঁদা ফুল বেলপাতা ভরসার চিহ্ন হয়ে।

সরস্বতী পুজো মানেই শুধু রোদ-রঙা হলুদ শাড়ি নয়, অনেকেরই প্রথম শাড়ি পরে শিহরিত হবার দিন। এমন কি সরস্বতী পুজো আমাদের সময়কার মেয়েদের জীবনেও ছিল প্রথম স্বাধীনতা দিবস। আমারা, ছেলেরা পুজো করতাম, রাত জেগে হিরো হয়ে প্যান্ডেলে বসে থাকতাম। নতুন জামা বা ফর্সা জামাও কখনও পরেছি বলে মনে পড়ে না। তখন তো নিজেদের গায়ের গন্ধে বুঁদ হয়ে থাকার বয়স। নতুন জামা পরে হাঁটা চলা করত একেবারে বাচ্চারা, যারা নিজেদের এই সব গোপন আমোদ তখনও আবিষ্কার করেনি।

আর সাজতো মেয়েরা। তখন আমাদের বয়সও তেরো চোদ্দো পনের ষোলো। মেয়েদের বয়স তার একটু কমই হবে। নতুন শাড়িই বেশি। বাসন্তী রঙ ছাড়াও ছিল গোলাপি, হাল্কা নীল, কত রকম। সুতির শাড়ির একচেটিয়া বাজার। তখনকার শাড়িতে বোধ হয় মাড় থাকতো বেশি। রোগা মোটা নানা শরীরে গোঁজা শাড়িগুলো ফুলে ফেঁপে থাকত। আমাদের পাড়ার তপুদা বলত— ‘দ্যাখ দ্যাখ, কেমন ফাঁপর ফাঁপর হয়ে আছে।’ আমরা দেখতাম। দু নয়ন ভরে দেখতাম আর বোঝার চেষ্টা করতাম কাকে বলে ‘কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা।’ আর তাই নিয়ে মনে মনে নিজের ফাল্গুনী রচনা করতাম।

স্কুল আমলে আমি ছিলাম দাদাগিরিতে ওস্তাদ। কিন্তু মেয়ে পটানোয় আমার অবস্থা খুব সুবিধের ছিল না। কিন্তু যারা মেয়ে তোলার ঠিক তুলত। আর মাঝে মাঝেই আমাদের সরস্বতী পুজোর টিম থেকেও দু এক জন হাওয়া হয়ে যেত, একটু ঘুরে আসি বলে। তখন তো মোবাইল ফোন আর এসএমএস আসেনি, দেখতাম একটু দূরে একটি মেয়ে ছোট বোন বা দু একটা এলেবেলে বন্ধু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী করে যেন কে নায়িকা আর কারা সহচরী ঠিক বোঝা যেত। একটা ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে কলেজের মাঠে টাইপের ঘটনা নিশ্চয় ঘটত। দেখতাম ছেলেটি হাওয়া। খানিক পরে ফিরে এসে আবার প্রসাদের প্যাকেট ভরা ইত্যাদি জরুরি কাজে ঢুকে পড়ত।

সরস্বতী পুজো মানেই বই না ছোঁয়া, গুরুজন গ্রাহ্য অনুমদিত হবার দিন। বড়োদের চোখে প্রশ্রয়ের সিগন্যাল পেয়ে বইপত্র দেবীর পায়ে গচ্ছিত রেখে, টো টো কোম্পানীতে যোগ দেওয়ার দিন। এক বছর প্রতীক্ষার পর কুল-বরই খাবার লাইসেন্স পাবার দিন। ভবিষ্যতের বিদ্যাসাগর-আইনস্টাইনদের হাতেখড়ির দিন। অলিখিত বকলমে বাংলা ভ্যালেন্টাইন ডে— রোমান্স-রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার— কেমন করে যেন সরস্বতী পুজোর ভ্যেনডায়াগ্রামের মধ্যে জুড়ে যায়, ঢুকে পড়ে উৎসবের অনুসঙ্গ হয়ে। ভোলাভালা সাদামাঠা থেকে এলেবেলে হয়ে কেউকেটে বনার দিন। খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর লাবড়া খাবার দিন।

‘শ্বেতপদ্মাসনা দেবীশ্বেতপুষ্পপদ শোভিতাশ্বেতাম্বর ধরানিত্যং শ্বেতগন্ধানুলেপন’— এতো শ্বেতের মধ্যে কোথা থেকে হলুদের উদয় হল সে রহস্য অনুন্মোচিতই রয়ে গেল সারা জীবন।

ফাল্গুন মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ আর বিদ্যাস্থানে বিল্বপত্র দিয়ে তাকে আহ্বান করা হয়। অন্যান্য পুজোর মতো শুধু অঞ্জলিতেই নয়, আয়োজনের অংশীদার ও ভাগীদার ছোটরাও। সংস্কৃত ভাষা না জেনেও একমাত্র সরস্বতী পুজোর অঞ্জলিমন্ত্র— ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে গড় গড় করে মুখস্থ বলে যেতে পারে মগজের কোষ। খাগের কলম, কালিতে ডুবিয়ে লিখতে কেমন লাগে, তার স্বাদও পাওয়া যায় সরস্বতী পুজোয়। আমার খাগ, বাবার সুলেখা কালিভরা নিবের কলম, বোনের মেড ইন চায়না ‘উইংসাঙ পেন’ আর অন্যদের ডটবল পেন পাশাপাশি শুয়ে জানায় চতুষ্কোণ উপস্থিতি। এ যেন বংশ পরম্পরায় কলমের বিবর্তনের ইতিহাসের প্রদর্শনী।

লক্ষ্মীপুজো একান্তই ঘরোয়া ও ব্যক্তিগত। দুর্গাপুজো হয় সাবেকি, নয় সর্বজনীন। কিন্তু সরস্বতী পুজোর বেলায়, যতই সকলে সর্বজনীন পুজোয় হন্তদন্ত হয়ে ছুটুক, তার আগে বাড়ির পুজো সারা চাই-ই চাই। এ ভাবেই সরস্বতী পুজো— ‘ওগো আমার, ওগো সবার’ পুজো। সরস্বতী পুজর নামে, কাঠ অ-রোমান্টিকেরও নস্টালজিক ছবির সিরিজ বেরিয়ে পড়ে মনের প্যান্ডোরার বাক্স থেকে।

বিদ্যার দেবীকে অগ্রাহ্য করবে, এমন অতিরিক্ত একটি মাথা, কারও ঘাড়ের ওপর ছিল নাকি? মাথার ভেতর মগজটির কদর ছাত্র-ছাত্রীদের চাইতে আর কে বেশী জানে? তাই সরস্বতী পুজো ছাত্র ছাত্রীদের সর্বজনীন পুজো। মাইক বাজনার দেবী সরস্বতী নন। বরং হুল্লোড়হীন তিনি স্কুল-কলেজ-হোস্টেল চত্বরে সকলের বাড়িতে বোন লক্ষ্মীর মতই স্বচ্ছন্দ-ঘরোয়া-আদৃত। মাত্র একদিনের পুজো, ড্যাং ড্যাং করে বাজনা নেই-ভাসান নেই-অন্য শহর থেকে আসা আত্মীয়েরা বাড়ি জুড়ে নেই। এতো সব ‘নেই’ এর মাঝেও ছাত্রশক্তি দলনেত্রী হয়ে তিনি স্থায়ী ভাবে বিরাজিত-উপাসিত।

আজ খুব জানতে ইচ্ছা হয়, সেই রামেরা হারিয়ে গেলেও, রাম রাজ্য কি এখনও অটুট আছে? নাকি সেই সব দিনগুলোকে গিলে ফেলেছে এইসব দিন, আরও অনেক অ্যান্টিক অভ্যাসের মতো।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.