জন্মদিনে স্মরণঃ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
বাবলু ভট্টাচার্য : সত্যজিৎ রায়ের অপু থেকে ফেলুদা। রুপালি পর্দা থেকে মঞ্চ। যেখানে পা রেখেছেন, সেখানেই অনন্য। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের একজন কিংবদন্তি অভিনেতা। আবার আদ্যন্ত খাঁটি বাঙালি।
বাংলা সিনেমায়, নাটকে, আবৃত্তিতে এক উদাহরণ হয়ে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উত্তম কুমারের একক কারিশমার সময়েও সৌমিত্রকে আলাদা করে পছন্দ করেছে দর্শক। রোমান্টিক নায়ক হিসেবেও তার জায়গা সমানভাবে রয়ে গেছে সেই হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণযুগের বাংলা ক্লাসিক ছবিতে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। অভিনয়ের এই প্রতিভাকে চিনতে ভুল করেনি অস্কার জয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের জহুরির চোখ। ১৯৫৯ সালে তাঁর ‘অপুর সংসার’ দিয়ে সৌমিত্রের রূপালি দুনিয়ায় হাতেখড়ি। এই ছবির মধ্য দিয়ে সৌমিত্র যেন রক্ত মাংসের রূপ দিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি অপুকে।
অতি অল্পসময়ের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের নজরকাড়ায় তিনি ‘সোনার কেল্লা’, ‘চারুলতা’ ও ‘ঘরে বাইরে’সহ এ চলচ্চিত্র নির্মাতার ১৪টি চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। ৬৭ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে প্রায় তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একই সঙ্গে অভিনেতা, নট ও নাট্যকার, বাচিক শিল্পী এবং কবি। তার চিত্রশিল্পী পরিচয়ও সবাইকে মুগ্ধ করেছে। একসময় ‘এক্ষণ’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তবে নিজের অভিনয় প্রেমের কথা জানিয়ে সৌমিত্র বলেন, ‘সেই শৈশব কাল থেকে আজ অবধি অভিনয় ছাড়া আমি অন্য কিছু ভাবিনি। অভিনয়টা সবসময় বুকের মধ্যে লালন করতাম। অন্য যা কিছু করেছি সবই ছিল ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ।’
সত্যজিত রায় ছাড়াও বাংলা ছবির প্রায় সমস্ত মননশীল পরিচালক সেইসময় থেকে এইসময়, যেমনঃ মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন, কৌশিক গাঙ্গুলী, অতনু ঘোষ, সৃজিত মুখার্জী সহ অনেকের সাথে কাজ করেছেন।
কবি ও নাট্যকার ডি এল রায়ের শহর নদীয়ার কৃষ্ণনগরে তার জন্ম। নাট্যচর্চার এই তীর্থক্ষেত্রেই গড়ে উঠেছিল তার নাটক করার মানসিকতা। ছাত্রজীবনেই নাটকে অভিনয় শুরু। কলেজ জীবনে অহীন্দ্র চৌধুরী ও পরবর্তী সময়ে নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির সান্নিধ্যে এসে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেয়ার ব্যাপারে সৌমিত্র মনস্থির করে নিয়েছিলেন। তবে প্রথমে আকাশবাণীতে কিছুদিনের জন্য ঘোষক হিসেবে কাজ করেছিলেন এই কালজয়ী অভিনেতা।
নায়ক হিসেবে তিনি তার সমসাময়িক সব নায়িকার বিপরীতেই সাফল্য পেয়েছেন। তেমন করে তাই কারো সঙ্গে জুটি গড়ে উঠেনি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’ ছবিতে সৌমিত্র হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এক অভিনেতা। তেমনি করে সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, অপর্ণা সেনরাও সৌমিত্রের সঙ্গে মিশেছেন অবলীলায়।
শুধু চলচ্চিত্রই নয়, বাংলার থিয়েটার মঞ্চও সাক্ষী থেকেছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় প্রতিভার। ফিল্ম নিয়ে নিত্যদিনের ব্যস্ততার ফাঁকেও মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। মঞ্চ থেকেই যেহেতু তার উত্থান, তাই মঞ্চকে নিজের অন্যতম প্রধান জায়গা বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘Officier des Arts et Metiers’ পেয়েছেন। সত্তরের দশকে তিনি পদ্মশ্রী পদক পেলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীকালে পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারে ভূষিত হন এই প্রতিভাবান অভিনেতা। এ ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন বাঙালি এই অভিনেতা।
১৫ নভেম্বর, ২০২০ তারিখে বেলভিউ হাসপাতালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের আজকের দিনে (১৯ জানুয়ারি) নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment