জন্মদিনে স্মরণঃ মা ক্সি ম গো র্কি
বাবলু ভট্টাচার্য : স্তালিন তখন রাশিয়ার সর্বাধিনায়ক। একদিন স্তালিন গেলেন ম্যাক্সিম গোর্কির কাছে। গিয়ে একান্তে অনুরোধ করলেন তার জীবনী লিখে দেওয়ার জন্য। স্তালিনের সেই অনুরোধ গোর্কি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। গোর্কি জানতেন, সাহিত্যিকের কাজ স্তাবকতা করা নয়। রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে উপহার নিয়ে তাকে খুশি করা নয়, সুবিধাবাদ নেওয়া নয় কিম্বা তার কথামতো জীবনী লিখে দেওয়া নয়। সাহিত্যিকের কাজ সত্যের মার্গদর্শন করানো।
বাবা-মার দেওয়া নাম আলেক্সেই পেশকভ। নিজেকে অবশ্য তিনি ‘মাক্সিম গোর্কি’ নামেই প্রকাশ করতে বেশি পছন্দ করতেন।
গোর্কি শব্দের অর্থ তিক্ত। আক্ষরিক অর্থে তিনি তাই ছিলেন। তার লেখায় সবসময় ফুটে উঠেছে তিক্ত সত্য। রাশিয়ার জনজীবনের নিঠুর বাস্তবতাকে তিনি কলমের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর সামনে। অকুতোভয় বীরের মতো জার সাম্রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন তার লেখনীর মধ্য দিয়ে।
বাবা-মার মৃত্যুর পর শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। শুরুটা হয় জুতার দোকানে কাজ নেয়ার মধ্য দিয়েই। ভালো না লাগায় এক সময় তা ছেড়ে দিয়ে কাজ নেন কয়েদি জাহাজে। সেখানে কর্মচারীদের বাসন ধোয়ার কাজ করতেন ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। প্রকৃতির রূপ, রস যার হৃদয়ে আসন পেতে বসেছিল, তাকে কি এই কষ্ট হার মানতে পারে! কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাই তিনি দু’চোখ ভরে দেখতেন নদীর অপরূপ দৃশ্য।
নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এক পেশা থেকে আরেক পেশায় ঘুরতে ঘুরতে বেড়ে উঠতে লাগলেন গোর্কি। পাশাপাশি নিজের মধ্যে গড়ে তুললেন বই পড়ার অভ্যাস। রাশিয়ায় তখন চলছিল জারের রাজত্বকাল। দেশজুড়ে শোষণ আর অত্যচার।
গোর্কি নিজের তাগিদেই যুক্ত হলেন বিপ্লবী দলের সঙ্গে। পাশাপাশি চলে জীবন-জীবিকার কাজ। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে মনের সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেন তিনি। এক পর্যায়ে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন।
তারপর শুরু করলেন লেখালেখি। স্থানীয় এক পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তার গল্প-কবিতা। এ সময় পরিচিত হন তরুণ লেখক ভ্লাদিমির করোলেঙ্কার সঙ্গে। জীবন যেন অন্যদিকে মোড় নিল গোর্কির। প্রথাগত রচনার ধারাকে বাদ দিয়ে শুরু হল তার নতুন পথের যাত্রা। সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনচিত্র প্রকাশ পেতে থাকে তার রচনায়। বিষয়গুলো পত্রিকায় ছাপার পর সবাই মুগ্ধ হয়ে তা পড়তেন।
১৮৯৮ সালে তার প্রবন্ধ ও গল্প নিয়ে একটি সংকলন বের হয়। এটি প্রকাশের পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সে সময়ের রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক চেখভ, তলস্তয়ের সঙ্গে গোর্কির নামও উচ্চারিত হতে থাকে সবার মুখে মুখে। ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ফোমা গর্দেয়ভ’।
এ উপন্যাসে তিনি নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের মর্মবেদনার কথা তুলে ধরলেন— যা এর আগে কেউ এমনভাবে প্রকাশ করতে পারেননি। এ উপন্যাস রুশ শাসকদের বিচলিত করে তোলে। বন্দি করা হয় গোর্কিকে। খুব শিগগিরই অবশ্য তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় রুশ সরকার।
১৯০১ সালে একবার সেন্ট পিটসবার্গের ছাত্র আন্দোলন চলছিল। পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে বেশ কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়, আহতও হয় অনেকে। এই ঘটনায় গোর্কির মনে তীব্র ঘৃণার জন্ম দেয়। প্রতিবাদ জানাতে হাতে তুলে নিলেন কলম। লিখলেন কবিতা। ‘ঝড়ো পাখির গান’ নামের এই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশে। উত্তাল জনসমুদ্র উপরমহলে ভয় ধরিয়ে দিলো। গ্রেফতার করা হলো গোর্কিকে। প্রিয় লেখকের গ্রেফতারে ক্ষোভে ফেটে পড়লো সারাদেশ। জার কর্তৃপক্ষ বাধ্য হলো গোর্কিকে ছেড়ে দিতে।
বিপ্লবী গোর্কির সমস্ত কার্যক্রম এবং সাহিত্যে ক্রমশই লেনিনের আদর্শের প্রচ্ছন্ন প্রভাব লক্ষণীয় হচ্ছিল। যোগাযোগ বাড়ছিল বিপ্লবীদের সাথে। এর কিছুই চোখ এড়ায়নি। গোর্কিকে নির্বাসনে পাঠানো হলো আরজামাস নামের এক ছোট্ট শহরে। আবার সারাদেশ উত্তাল হল প্রতিবাদে। প্রতিবাদে যোগ দিলেন স্বয়ং তলস্তয়, লেনিনের মতো মহারথীরা। এরই মধ্যে গোর্কি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পাঠানো হল ক্রিমিয়ার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে হাত দিলেন তার অন্যতম বিখ্যাত নাটক ‘লোয়ার ডেপথ’ রচনার কাজে। ১৯০১ সালে নাটকটি প্রকাশিত হয়। এই নাটকে গোর্কি মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। এবারে শুধু রাশিয়া নয়, গোর্কির নাম ছড়িয়ে পড়লো গোটা ইউরোপে।
শাসকশ্রেণীর অন্যায়-অত্যাচারের বিরূদ্ধে সবসময়ই সরব ছিলেন গোর্কি। এজন্য তাকে জেলবন্দী হতে হয়েছে বহুবার। জারের অত্যাচারে একসময় আমেরিকায় পাড়ি জমাতে বাধ্য হন তিনি। সেখানেই রচিত হয় তার জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘মা’, যার মধ্য দিয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন বিপ্লব ছাড়া শোষিত শ্রেণীর মুক্তি কখনোই সম্ভব নয়।
‘মা’ ছাড়াও গোর্কির লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘তারা তিনজন’, ‘আমার ছেলেবেলা’ ইত্যাদি বেশ বিখ্যাত। গোর্কি শেষজীবনে লেখা শুরু করেন তাঁর আরেক উপন্যাস ‘ক্লিম সামগিনের জীবন’। যদিও এই উপন্যাস তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
১৯৩৬ সালের ১৮ জুন গোর্কি মারা যান। মৃত্যুর আগের বেশ কিছু সময় তাকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়েছিলো।
মাক্সিম গোর্কি ১৮৬৮ সালের আজকের দিনে (২৮ মার্চ) রাশিয়ার নিজনি নভগরোদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment