স্মরণঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বাবলু ভট্টাচার্য : বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কথাসাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়— যিনি তাঁর সীমিত কালখণ্ড ও ভূমিখণ্ডকে স্বচ্ছন্দে অতিক্রম করে এক যুগোত্তীর্ণ মর্যাদায় অধিষ্টিত হয়ে আছেন বাঙালি পাঠকসমাজে।
শরৎচন্দ্রের কালজয়ী খ্যাতি দেশের সীমাকে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পরিলঙ্ঘন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তারলাভ করে বিদেশি পাঠকদের মনকেও জয় করেছে। তাই তিনি পরিচিত হলেন অপরাজেয় কথাশিল্পী হিসেবে। শরৎচন্দ্রের প্রায় সব কটি রচনার কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা— যা বাঙলা সাহিত্যে নয় বরং সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যের বিরল দৃষ্টান্ত।
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে শরৎচন্দ্র এমন একটি নূতন পথ ধরে অগ্রসর হয়েছেন যা বাঙলা কথাসাহিত্যের পরিধিকে প্রসারিত করে দিয়ে তার মধ্যে এনেছে এক অদৃষ্টপূর্ব বৈচিত্র্য। সংবেদনশীল হৃদয়, ব্যাপক জীবনজিজ্ঞাসা, প্রখর পর্যবেক্ষণশক্তি, সংস্কারমুক্ত স্বাধীন মনোভঙ্গি প্রভৃতির গুণে শরৎসাহিত্য লাভ করেছে এক অনন্যসাধারণ বিশিষ্টতা— যা পরবর্তীকালের বাঙলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত করেছে।
শরৎচন্দ্রের সমস্ত উপন্যাস ও ছোট গল্পগুলিকে প্রধানত পারিবারিক, সামাজিক ও মনস্তত্ত্বমূলক— এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করলেও তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসের কেন্দ্রভূমিতে বিরাজমান রয়েছে বাঙালীর সমাজ সম্পর্কে এক বিরাট জিজ্ঞাসা এবং বাঙালির মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ জীবনের রূপায়ণ। সমাজের বাস্তব অবস্থা নরনারীর জীবনভঙ্গিমা ও জীবনবোধকে নিয়ন্ত্রিত করে তাদের মানসলোকে যে সূক্ষ্ম জটিল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, শরৎসাহিত্যে আমরা পাই তারই সার্থক রূপায়ণ।
বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের দুঃখবেদনার এতবড় কাব্যকার ইতিপূর্বে দেখি নি আমারা। মূঢ়তায় আচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুর শাসনে লাঞ্ছিত নরনারীর অশ্রুসিক্ত জীবনকথা অবলম্বন করে মানবদরদী শরৎচন্দ্র গদ্যবাহিত যে কতকগুলি উৎকৃষ্ট ট্রাজেডি রচনা করেছেন তাতে বাঙলা সমাজের অতিবিশ্বস্ত ও বহুচিত্রিত এক আলেখ্য উন্মোচিত হয়েছে আমাদের সামনে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৮ সালের আজকের দিনে (১৬ জানুয়ারি) কলকাতার বালিগঞ্জে মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment