———-জন্মদিনে স্মরণঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়——
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, বাবা ভেবেছিলেন, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ছেলে ভেবেছিল, সে হবে সাহিত্যিক। বাবার ইচ্ছেপূরণের জন্য ছেলে ভর্তি হয়েছিল যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। নিজেকে সাহিত্যের বেষ্টনীতে আটকাতে ছেলে শুরু করেছিল লেখালেখির চর্চা। কিন্তু মাঝপথে থমকে গেল দু’জনের ইচ্ছে। ছেলের জীবনে জড়িয়ে গেল গান। দিনে দিনে গানই হয়ে উঠল তার জগৎ, ধ্যান-জ্ঞান-নেশা এবং শেষমেশ পেশাও। বন্ধুবান্ধবের গণ্ডি পেরিয়ে তার গান যখন প্রথম বেতারে ভেসে এল, বাঙালি শুনল মন্ত্রমুগ্ধ এক কণ্ঠ। শুনল একটি নাম— হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
হাতা গোটানো সাদা বাংলা শার্ট। সাদা ধুতি। কালো ফ্রেমের চশমা। ব্যাক ব্রাশ করা চুল। নম্র উচ্চারণের আলাপচারিতা। রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আধুনিক, ফিল্মের প্লে ব্যাক থেকে ফাংশনের ম্যারাপ, খাদ থেকে চড়া— সর্বত্র যাতায়াতে অভ্যস্থ দরাজ গলা। ‘ব্র্যান্ড হেমন্ত’র এ সবই ছিল এক একটা ‘আইকনিক’ চিহ্ন। সলতে পাকানোর শুরুটা মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময়ে। গান গাওয়ার ‘অপরাধে’ সেখান থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয় এক বার। তখন তার দশম শ্রেণি। শেষে অনেক ধরে করে নির্দেশ প্রত্যাহার করা হয়। বাবা কালীদাস মুখোপাধ্যায় ছিলেন সামান্য কেরানি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহরু গ্রামে তার পৈতৃক ভিটে। কালীদাসবাবুর শ্বশুরবাড়ি ছিল বারাণসীতে। স্ত্রী কিরণবালাদেবীর বাবা সেখানকার হাসপাতালের সিভিল সার্জেন। কৃতী এবং বেশ নাম করা ডাক্তার। মুখোপাধ্যায় দম্পতির চার ছেলে এবং এক মেয়ের মধ্যে হেমন্ত ছিলেন দ্বিতীয়। তার ছেলেবেলা কাটে বহুড়াতে। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর কালীদাসবাবু সপরিবার কলকাতায় চলে আসেন। শহরে হেমন্তদের ঠিকানা হয় ভবানীপুর। হেমন্ত প্রথমে ভর্তি হন বাড়ির কাছে নাসিরুদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুলে। তার পর মিত্র ইনস্টিটিউশন।
সহপাঠীদের মধ্যে হেমন্তের প্রিয় বন্ধু ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামসুন্দর। তাদের বাড়িতে ছিল হারমোনিয়ম-তবলা- গ্রামোফোন রেকর্ড। শ্যাসুন্দরদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু হয়। রেকর্ডের গান শোনা থেকে হারমোনিয়ম বাজিয়ে সেই গান তোলা— সবই চলতে থাকে ওই বাড়িতে। বন্ধুদের মধ্যে সুভাষ (মুখোপাধ্যায়) হঠাৎ বন্ধু হেমন্তকে রেডিওতে গান গাওয়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগল।
অডিশন দিলেন হেমন্ত। তখন তার বয়স বছর ষোলো হবে। তিন মাস পরে বাড়িতে চিঠি এল। এ বার রেকর্ডিং। সব ঠিকই ছিল, কিন্তু বাবাকে রাজি করানোটাই তার কাছে বড় ব্যাপার। যাইহোক বাবাকে রাজি করিয়েছিলেন মা কিরণবালাদেবী। কিন্তু রেকর্ডিং-এ গাইবে কী? পরিত্রাতা সেই সুভাষ। হেমন্তের অনুরোধে রাতারাতি লিখে ফেললেন একটি গান। প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলেন হেমন্ত। এই সময়ে বাবার বন্ধু শান্তি বসুর মাধ্যমে পরিচয় হল শৈলেশ দত্তগুপ্তের সঙ্গে। তিনি তখন কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানির ট্রেনার। গান শুনে হেমন্তের রেকর্ড করালেন শৈলেশবাবু। পনেরো দিনের মধ্যে রেকর্ড বাজারে এল। সেটা ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাস। ব্যস, আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি হেমন্তকে। শুরুর দিনগুলো থেকেই হেমন্ত নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে শুধু কাজ করে গিয়েছেন। আসলে এই সলতে পাকানোর দিনগুলো পেরোতে পেরোতেই হেমন্ত দখল করে নিয়েছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের মন।
চল্লিশের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম প্লে ব্যাক করলেন হেমন্ত, ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবিতে। তার পরে বেশ কিছু ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা। এর মধ্যেই সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে তিনি পর পর কয়েক বছর রেকর্ড করলেন বেশ কয়েকটি গান- ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ থেকে ‘রানার’— বাঙালি অন্য ভাবে পেল এই জুটিকে। একই সময়ে বের হওয়া তার আধুনিক গানের রেকর্ডগুলিও ভীষণ জনপ্রিয় হয়। ১৯৫১ সালে বোম্বাই পাড়ি দিলেন হেমন্ত, ‘আনন্দমঠ’ ছবিতে সুর করবেন বলে। হিন্দিভাষীরা পেলেন নতুন এক গায়ক— হেমন্তকুমার। তার কণ্ঠে মুগ্ধ তখন প্রায় সারা ভারত। বেশ কিছু নামকরা চলচ্চিত্রে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুর সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে আছে- ‘হারানো সুর’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘লুকোচুরি’, ‘স্বরলিপি’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘শেষ পর্যন্ত’, ‘কুহক’, ‘দুই ভাই’, ‘সপ্তপদী’ এবং হিন্দিতে অসংখ্য গানের সুরকার ও শিল্পী তিনি।
পঞ্চাশের দশকে সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার এবং গায়ক হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম আকাশস্পর্শী। তিনি এ বার নিজেকে নিয়ে এলেন চলচ্চিত্র প্রযোজকের ভূমিকায়। প্রথম বাংলা ছবি মৃণাল সেনের পরিচালনায় ‘নীল আকাশের নীচে’।এরপর একে একে হিন্দি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে থাকেন। যেমন, বিশ সাল বদ, কোহরা, বিবি অওর মকান, ফরার, রাহগির এবং খামোশি- উপরোক্ত সব চলচ্চিত্রেই সুর সৃষ্টি করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সালে ৬৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯২০ সালের আজকের দিনে (১৬ জুন) বারাণসিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment