Press "Enter" to skip to content

শচীন দেববর্মন এর হওয়ার কথা ছিল ত্রিপুরার রাজা, হয়ে গেলেন আধুনিক বাংলা গানের মুকুটহীন সম্রাট….।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ শ চী ন দে ব ব র্ম ণ

বাবলু ভট্টাচার্য : ‘সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল’– এ শুধু তাঁর গানের পঙক্তি নয়, আশ্চর্য বৈভব মণ্ডিত তাঁর সঙ্গীত জীবনের চলার ছন্দ। তিনি বাংলা সঙ্গীতের রাজপুত্র– শচীন দেব বর্মণ।

হওয়ার কথা ছিল ত্রিপুরার রাজা, হয়ে গেলেন আধুনিক বাংলা গানের মুকুটহীন সম্রাট। ‘সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা বাংলা মায়ের কোল’– আজও যে গান তাঁর সুরের মায়ায় আমাদের দুলিয়ে দেয়।

পিতা নবদ্বীপচন্দ্রদেব বর্মন, মা মণিপুরের রাজকুমারী নির্মলা দেবী৷ বাল্য ও কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে কুমিল্লাতেই৷ দু’বছর বয়সে মাতৃহারা হন৷ কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হলেও গানের জন্য শিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যায়।

পিতা চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার পর পুত্র আগরতলায় ফিরে গিয়ে রাজকার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন৷ কিন্তু শচীন আবদ্ধ হলেন সুরের মায়ায়। চেতনায় তখন ত্রিপুরার বাঁশের বাঁশি, ভাটিয়ালির সুর, মাঝি-মাল্লাদের জীবন ও জীবিকার সুর, গোমতী নদীর অপরূপ ছন্দ, কুমিল্লার গাছ-গাছালি, নদী- নালা আর মাঝি-মাল্লাদের মাটির গন্ধমাখা সুর।

কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রথম গান গাইলেন ১৯২৫ সালে৷ তখন সবে কলকাতা বেতারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শচীনদেবের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে।

ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সন্তান হওয়ায় পারিবারিক আভিজাত্য শচীনদেবের শিল্পী হয়ে ওঠা বা প্রতিষ্ঠায় অনুঘটকের কাজ করেনি বিন্দুমাত্র, বরং কিছুটা অভিমানই ছিল রাজ পরিবারের প্রতি।

১৯৪৪ সালে স্থায়ীভাবে মুম্বাই চলে যাবার পর ত্রিপুরার প্রতি ভালোবাসার টান থাকলেও রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হতে থাকে। ১৯৪৬ সালের পর শচীনদেব আর আগরতলায় যাননি। কোন রাজপরিবারের আভিজাত্যের ছাপ না থাকা মীরা দাশগুপ্তাকে বিবাহ আগরতলায় তাঁর পরিজনরা মেনে নেয় নি। তাঁর অভিমান ও রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণ হয়তো এটাই।

পরিতাপ ও লজ্জার কথা, সহধর্মিণী শিল্পী মীরাদেব বর্মণ– যার ত্রিপুরার রাজবধূ হওয়ার কথা ছিল; তাঁর শেষ জীবনের আশ্রয় হয়েছিল মুম্বাই শহরতলীর বারো ফুট বাই দশ ফুট ঘরের এক বৃদ্ধাশ্রমে। মুম্বাই ফিল্ম জগতে শচীনদেবের অবদান আর নিজেরও প্রতিষ্ঠার মূলে যে মানুষটার অবদান সবচেয়ে বেশি তাও ভুলে গিয়েছিলেন শচীনদেবেরই পুত্রবধূ আশা ভোসলে।

রাহুলদেব চলে গেছেন, মুম্বাই ফিল্ম জগতও চমকে ওঠেনি। শচীনদেবের পুত্রবধূ আশা ভোশলে চুপি চুপি নবতিপর মীরাকে রেখে এসেছিলেন এক বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষও জানতেন না কে এই বৃদ্ধা, যখন মীরাকে সম্মানিত করার কথা জানিয়ে ত্রিপুরা সরকারের চিঠি তাদের ঠিকানায় পৌঁছেছিল।

এক আশ্চর্য সাংগীতিক আভিজাত্যের মোড়ক শচীনদেবকে মর্যাদা মণ্ডিত করেছিল। কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে গান শিখেছিলেন৷ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। হিন্দি সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনায় গগনচুম্বী খ্যাতি পেয়েছিলেন৷ কিন্তু নিজেকে এক মর্যাদা মণ্ডিত ‘ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে দেননি কাউকে৷

আধুনিক বাংলা গানের গায়ন শৈলীতেই এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। শুধুমাত্র ঈষৎ অনুনাসিক ও দরাজ কণ্ঠস্বরের জন্যই নয়, বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় আত্মীয়তার ফলে বাংলার লোক সুর আর মাঝি- মাল্লাদের সঙ্গে মিশে তাদের সুরের মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা গানকে দান করেছিলেন অপার ঐশ্বর্য।

আমাদের অপার বিস্ময় বাংলা ছায়াছবি শচীনদেবের সুরের ঐশ্বর্য প্রায় বর্জনই করেছিল। ১৯৩২ সালে বাংলা ছায়াছবি সবাক হওয়ার পর ১৯৩৮ সালের মধ্যে মাত্র ৫/৬টি বাণিজ্যিক ভাবে অসফল বাংলা ছায়াছবিতে তিনি গান গেয়েছিলেন।

তিনি অন্যের সুরে গান করতেন না। সঙ্গীত পরিচালক অন্য কেউ হলেও তাঁর গীত গানের সুর তিনি নিজেই করতেন। শুধুমাত্র একটি ছায়াছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে একটি গান করতে সম্মত হয়েছিলেন।

১৯৪২ সালে মুম্বাই যাওয়ার প্রথম ডাক পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বাংলাতেই থাকার। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র জগত থেকে কোন ডাক না পেয়ে অভিমানাহত হয়ে ১৯৪৪ সালে মুম্বাই চলে গেলেন পাকাপাকি ভাবে। তারপর হিন্দি সিনেমার গান তাঁর সুরের জাদুতে কি অসামান্য উচ্চতা স্পর্শ করেছিল তা তো ইতিহাস হয়ে আছে।

শচীনদেব বর্মণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন– পদ্মশ্রী, সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার, এশিয়া ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার, সন্ত হরিদাস পুরস্কার৷ পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার পুরস্কার৷

২০০৭ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ তাঁর সম্মানে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে ৷

শচীনদেব বর্মণ ১৯০৬ সালের আজকের দিনে (১ অক্টোবর) বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন।

More from MusicMore posts in Music »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.