জন্মদিনে স্মরণঃ অবন ঠাকুর
বাবলু ভট্টাচার্য : নিজেকে বলতেন নিষ্কর্মা, কখনও বা খ্যাপা। কিন্তু তাঁর মনটা ছিল শিশুর মতোই সরল। জীবদ্দশাতেই তাঁর শিল্পধারা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছিলেন এক কিংবদন্তী। তিনি অবন ঠাকুর— বেঙ্গল স্কুলের সেই পথিকৃত— যাঁর শিল্পসত্ত্বা জন্ম দিয়েছিল এক নব্যবঙ্গীয় চিত্রকলার রীতির।
তিনি সেই শিল্পাচার্য— যাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেঙ্গল স্কুলের পরবর্তী শিল্পীরা এ দেশের আধুনিক চিত্রকলার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। অসামান্য এক শিক্ষক, এসরাজ বাদক, অভিনেতা। এ সবের পাশাপাশি চলত সাহিত্যচর্চাও। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আটপৌরে, স্নেহশীল, কর্তব্যপরায়ণ এক জন মানুষ।
ছেলেবেলায় দুষ্টুমির জন্য তাঁকে বাড়িতে ‘বোম্বেটে’ নাম দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় দোতলার বারান্দায় একটা জলভর্তি টবে কিছু লাল মাছ থাকত। একদিন তাঁর হঠাৎ মনে হল লাল মাছ তাই লাল জলে থাকা উচিত। অমনি লাল রং জোগাড় করে তাতে ঢেলে দিয়েছিলেন। পরে মাছগুলি সব মরে ভেসে উঠেছিল।
ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও প্রথমে প্যাস্টেলে হাত পাকিয়ে তার পরে অয়েল পেন্টিং শিখেছিলেন সি এল পামারের কাছে। তার পরে জলরঙের কাজ শিখেছিলেন। প্রথম দেশীয় ধরনের ছবি ‘শুক্লাভিসার’ এঁকে তাঁর মন ভরেনি। তাই মনে মনে ঠিক করেছিলেন দেশীয় টেকনিক শেখার কথা। এর পরই বৈষ্ণব পদাবলীর এক সেট ছবি এঁকেছিলেন। এর পরে একে একে এঁকেছিলেন, আরব্য রজনী, শাহজাহানের মৃত্যু, ভারতমাতা, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি কত না ছবি!
অবনীন্দ্রনাথের জীবনে হ্যাভেল সাহেবের বড় প্রভাব ছিল। সেই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন— ‘ভাবি, সেই বিদেশি-গুরু আমার হ্যাভেল সাহেব অমন করে আমায় যদি না বোঝাতেন ভারতশিল্পের গুণাগুণ, তবে কয়লা ছিলাম, কয়লাই হয়তো থেকে যেতাম, মনের ময়লা ঘুচত না, চোখ ফুটত না দেশের শিল্প সৌন্দর্যের দিকে।’
এক দিন প্রখ্যাত শিল্পী রবি বর্মা জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি দেখতে। ছবি দেখে রবি বর্মা খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন— ‘ছবির দিকে এর ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল।’ তেমনই লর্ড কার্জন এক সময় অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি কিনতে চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যখন চিত্রাঙ্গদা লিখেছিলেন, তখন অবনীন্দ্রর উপর নির্দেশ এসেছিল ছবি দেওয়ার জন্য। সেই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ‘…এই হল রবিকাকার সঙ্গে আমার প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ। তার পর থেকে এতকাল রবিকার সঙ্গে বহু বার আর্টের ক্ষেত্রে যোগাযোগ হয়েছে, প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তাঁর প্রেরণা।’
আবার রবীন্দ্রনাথের রাখীবন্ধন ও স্বদেশি আন্দোলনের তিনিই ছিলেন অন্যতম সঙ্গী তথা উদ্যোক্তা। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে তাঁর লেখালেখির শুরু। প্রথমে ‘শকুন্তলা’ লিখে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা পেয়ে তার পরে লিখেছিলেন ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজকাহিনি’, ‘বুড়োআংলা’ ইত্যাদি।
এক সময় কলকাতা প্লেগের আতঙ্কে ভুগছিল। চারদিকে মহামারির আকার ধারণ করেছিল। সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও বাড়ির সকলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছিলেন। কিন্তু সেই প্লেগ ঢুকল অবন ঠাকুরের নিজের ঘরে। ছিনিয়ে নিয়েছিল তাঁর ছোট্ট মেয়েটিকে। সেই শোক ভুলতে কিছু সময়ের জন্য জোড়াসাঁকো ছেড়ে তাঁরা চৌরঙ্গির একটা বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেই একটু একটু করে বদলে গিয়েছিল সেই জোড়াসাঁকো। জমিদারির আয় কমে যাওয়ায় মূলত অর্থনৈতিক কারণেই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে পরিবার এত দিন মিলেমিশে ছিল তা এ বার পৃথক হয়েছিল। ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবারকে। পরবর্তী ঠিকানা হল বরাহনগরের গুপ্ত নিবাস।
এখানেই অবনীন্দ্রনাথ কাটুম-কাটাম তৈরিতে মন দিয়েছিলেন। যদিও এর সূত্রপাত হয়েছিল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। গাছের নীচে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ির ছাল, নারকোলের ছোবড়া, বাঁশের টুকরো ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হত নানা আকৃতির এবং নানা বিষয়ের শিল্পদ্রব্য।
তিনি ১৯৫১ সালে ৫ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
অবন ঠাকুর ১৮৭১ সালের আজকের দিনে (৭ আগস্ট) কলকাতার জোড়াসাঁকোতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment