জন্মদিনে স্মরণঃ নী লি মা সে ন
বাবলু ভট্টাচার্য : ৬ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথম যাওয়া। সেখানকার পাঠভবনে পড়ার সময় নাচ, গান ও খেলায় সকলের নজর কেড়ে নেওয়া মেয়েটিই ভবিষ্যতের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নীলিমা সেন।
তবে আজীবন তাঁর ‘বাচ্চু’ নামটি কাছের মানুষদের আন্তরিক স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়নি মোটেই। সে নামেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন রবীন্দ্র মহলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নাটকের হাতেখড়ি হয়েছিল নীলিমার। ‘ডাকঘর’-এ অমলের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন গুরুদেব নীলিমাকে। তিনি নিজে ঠাকুরদার চরিত্রে অভিনয় করবেন— এমনই কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কবি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তা আর মঞ্চস্থ হয়নি।
ললিতমোহন গুপ্ত ও পঙ্কজিনীদেবীর মেয়ে নীলিমার ছোটবেলার সঙ্গে জড়িয়ে যায় কবিগুরুর স্বপ্নস্থান শান্তিনিকেতন। নীলিমারা থাকতেন শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লির সোনাঝুরিতে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য সে বাড়ি ছিল অবারিত দ্বার।
ছোটবেলা থেকেই নীলিমার গীতবিতান থেকে গান মুখস্থ করার অভ্যেস ছিল। মাত্র ১২ বছর বয়সে পাঠভবন থেকে সঙ্গীতভবনে গেলেন। ওখানে চার বছরের কোর্স সম্পূর্ণ করে আবার পাঠভবনে ফেরা। সেখান থেকেই ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক, তার পর একে একে আইএ ও বিএ পাশ করেন।
১৯৪৪-এ তাঁর প্রথম রেকর্ড— ভারত কোম্পানি থেকে ‘বুঝি বেলা বয়ে যায়’ এবং ‘আমার দোসর যে জন ওগো তারে কে জানে’ প্রকাশিত হয়। বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে ১৯৭২ সালে প্রথমে লেকচারার-এর পদে নিযুক্ত হন, ক্রমে সেখানেই বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যক্ষ হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৩ তে সঙ্গীতভবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন নীলিমা সেন।
গান শিখেছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, ইন্দিরা দেবীচৌধুরানি (বিবিদি), কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (মোহরদি), ইন্দুলেখা ঘোষ ও অমিতা ঠাকুরের কাছে। অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এস্রাজ, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভিভি ওয়াঝেলওয়ারের কাছে শিখেছিলেন।
কলকাতার সঙ্গীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘সুরঙ্গমা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। অল্প কয়েকদিন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নীলিমা যুক্ত ছিলেন। শৈলজারঞ্জন মজুমদার তাঁকে প্রথম নিয়ে যান আকাশবাণীতে। কলকাতার আকাশবাণীতে নীলিমা সেন সঙ্গীতশিক্ষার আসরও করেছেন।
১৯৫০ সালে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপক ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিয়কুমার সেনের সঙ্গে নীলিমার বিবাহ হয়। তাঁদের কন্যার নাম নীলাঞ্জনা। বিয়ের পরের বছরই স্বামীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান নীলিমা। সেখানে নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল সায়েন্স ও রেড ক্রস আয়োজিত ফাস্ট এইড-এ সার্টিফিকেট পান। নীলিমা সেন স্বামীর সঙ্গে যৌথ ভাবে লেখেন রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ ‘সুরের গুরু’।
রবীন্দ্রনাথের গানের একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন নীলিমা সেন। ১৯৪৪-এ প্রথম রেকর্ডের পর ১৯৪৭-এ কলম্বিয়া থেকে তাঁর গান ‘রোদনভরা এ বসন্ত’ ও ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’ প্রকাশ পায়। এর পর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ‘গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে’ ও ‘বাজাও রে মোহন বাঁশি’। এরপর একে একে ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়’, ‘না বলে যায় পাছে সে’, ‘ওই শুনি যেন চরণধ্বনি রে’, ‘তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে’— মোট ৬টি গান বের হয়।
গাঁধীজি তখন শেষ বারের মতো শান্তিনিকেতনে এসেছেন। কবিগুরু এক বার যে গানটি শুনিয়ে গাঁধিজীর অনশন ভাঙিয়েছিলেন নীলিমা তাঁকে শোনালেন সেই গান— ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’।
১৯৭৪-এ বাংলাদেশে ‘সৎ সঙ্গীত প্রসার সমিতি’র আয়োজনে পরিবারের সকলে ও শৈলজারঞ্জন বাংলাদেশে আসেন। এর প্রায় দশ বছর পর ১৯৮৪ সালে ফের বাংলাদেশ এসেছিলেন নীলিমা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে প্রধান অতিথি হয়ে। সেখানকার রবীন্দ্রমেলায় যোগ দেয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ ও সঙ্গীত’ বিষয়ে গবেষণাপত্র পড়েছিলেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মশতবর্ষে বিশ্বভারতীর একটি প্রতিনিধিমূলক সাংস্কৃতিক দলের নেত্রী হয়ে তিনি সিঙ্গাপুর, জাকার্তা-সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় নানা অনুষ্ঠান করেন। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের আমন্ত্রণে ‘ছায়ানট’ আয়োজিত একটি কর্মশালায় যোগ দিতে আসা ছিল তাঁর কাছে এক অনন্য অনুভূতি।
১৯৯৬ সালের ২৮ জুন নীলিমা সেন তাঁর চিরপরিচিত রবীন্দ্রজগৎ ছেড়ে চলে যান অমৃতলোকের আহ্বানে।
নীলিমা সেন ১৯২৮ সালের আজকের দিনে (২৮ এপ্রিল) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment