Press "Enter" to skip to content

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার রোজ দেখা হয়। সকালে-বিকালে, দিনে-রাতে, সন্ধ্যায়। বিষাদে এবং একাকীত্বে। রবীন্দ্রনাথ আমাকে বাঁচতে শেখান…..।

Spread the love

আমার রবীন্দ্রনাথ

বাবলু ভট্টাচার্য : চারিদিকে ভেসে যাচ্ছে ধু ধু জ্যোৎস্নায়। এই মাঠ, এই প্রান্তর, দুরের বনরাজি– সব। অনেক বছর আগে, একবার পৌষের ভোরে শান্তিনিকেতনে আমি তাঁকে দেখেছিলাম। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন। নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়েছিলেন আমার চোখের জল। এক অদ্ভুত পৌষের ভোর এলো সেদিন আমার জীবনে। কুয়াশার ভিতর থেকে নেমে এল এক অপরূপ আলো। পা ভিজে গেল শিশিরে। এই রকম এক পৌষের ভোরে, ভুবনডাঙার মাথার উপর দিয়ে যখন দুটো ফিঙে উড়ে যাচ্ছিল নিজেদের মধ্যে কিচির মিচির করতে করতে, ঠিক তখন তিনি এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে।

জীবনে সমস্ত অপমান এবং অবজ্ঞার ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়িয়ে, কিভাবে অনন্তযাত্রা পথটিকে চিনে নিতে হয়, কিভাবে এই নক্ষত্ররাজিতে খুঁজে নিতে হয় জীবনের অন্যতর অর্থ– তিনি সেদিন শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরের আকাশ থেকে দেবব্রত বিশ্বাসের আকাশে– সর্বত্র খেলা করে গিয়েছেন তিনি।

যখন বর্ষার বিকেল কিংবা পৌষের সকালে ভুবনডাঙা ছাড়িয়ে, খোয়াইয়ের ধার দিয়ে হেঁটে গেছি একা একা, তখনও তিনি আমার পাশে পাশে হেঁটেছেন। মুছিয়ে দিয়েছেন আমার সর্বাঙ্গ জুড়ে লেগে থাকা লজ্জ্বা ও অপমান।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার রোজ দেখা হয়। সকালে-বিকালে, দিনে-রাতে, সন্ধ্যায়। বিষাদে এবং একাকীত্বে। রবীন্দ্রনাথ আমাকে বাঁচতে শেখান। একমাত্র তিনি-ই আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছেন।

কলকাতার শতাব্দী প্রাচীন মিলন সমিতির কবিগুরু'র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

উত্তর কলকাতার শতাব্দী প্রাচীন মিলন সমিতি ক্লাবে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।

জীবনে প্রথম মদ্যপান করেছিলাম ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়। তখন আমার একজন প্রেমিকা ছিল। গোবরডাঙা পোস্টঅফিস পাড়ার বাসিন্দা ছিল সে। তাদের বাড়ির ছাদে টবে বেড়ে উঠেছিল একটি পাতাবাহার গাছ। বারান্দার খাঁচায় ঝুলত একটা টিয়া পাখি।

এক ঝুলনপূর্ণিমার সন্ধ্যেয়, আমার সেই অপক্ক (Immature) প্রেমিকা, তাদের জীর্ণ এবং পুরনো বাড়ির ছাঁদে আমার গলা জড়িয়ে ধরে গেয়ে উঠেছিল– ‘আমার বাসনা আজি/ত্রিভুবনে ওঠে বাজি/কাঁপে নদী বনরাজী/বেদনা ভরে…’।

অফুরন্ত বাদামের খোসা ভাঙতে ভাঙতে আমার সেই প্রেমিকা কবে ছেড়ে চলে গিয়েছিল আমাকে। সে এখন দুর্গাপুর স্টিল ফ্যাক্টারির এক ইঞ্জিনিয়ারের ঘরণী। তার কোমরের খাঁজে ঈষৎ মেদ জমেছে, দুই সন্তানের জননী সে এখন। এবার কলকাতা গিয়ে দেখা হল তার সাথে পার্ক স্ট্রীটের অক্সফোর্ড বইয়ের দোকানে।

সেদিন সন্ধ্যায় অনেকটা পথ একসঙ্গে হেঁটে ছিলাম আমরা। নতমুখে, আমার ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকা, আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন সন্ধ্যায় গুন গুন করে গেয়ে চলেছিল– ‘অনেক দিনের আমার যে গান, আমার কাছে ফিরে আসে/তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন বাতাসে…’

আসলে, কিছুই ফিরে আসেনা আর। বারেবারে ফিরে আসেন একজনই, তিনি রবীন্দ্রনাথ। তিনি আমাকে ছেড়ে জাননা কখনো। তিনি জানেন, অপার অনন্ত ধনরাজি যাদের নেই। এই অনন্তযাত্রা পথে একমাত্র আকাশের নক্ষত্রই যাদের সঙ্গি– তাদের ছাড়তে নেই। তাই তিনি ছেড়ে জাননা কখনো।

কিংবা, বারেবারে আমিই হয়তো ফিরে ফিরে যাই রবীন্দ্রনাথের কাছে, সমস্ত প্রত্যাখ্যান এবং পরাজয়ের লজ্জা নিয়ে আমিই বারে বারে ফিরে যাই তাঁর কাছে। আকাশের মত একমাত্র তাঁরই আকাশে আশ্রয় খুঁজি আমি।

ভরা বর্ষায় ভেসে যায় আমার ঘর। তছনছ হয়ে যায় আমার সমস্ত আশ্রয়, তবুও, মাঝে মাঝে আমার ভাঙা ঘরের চাল দিয়ে এক টুকরো জ্যোৎস্নার আলোর মতো নেমে আসেন রবীন্দ্রনাথ। সমস্ত বিষাদে এবং একাকীত্বে, সমস্ত প্রবঞ্চনা এবং লজ্জায়, সমস্ত ভালোবাসা এবং প্রত্যাখ্যানে– আমি শুধু রবীন্দ্রনাথকেই আশ্রয় করি।

সমস্ত পরাজয়ের লজ্জা এবং গ্লানি মেখে নিয়ে, রাতে আমি ফিরে আসি আমার ঘরহীন ঘরে। সমস্ত শহর তখন ঘুমিয়ে থাকে; মরা আলোয় এক প্রেতজ্যোৎস্না নেমে আসে এই পৃথিবীতে। চরাচর জুড়ে শুধু ছড়িয়ে থাকে প্রবঞ্চনা আর প্রতিহিংসার গল্প।

রাতে, ওই অন্ধকার পথ ধরে বাড়ি ফিরতে আমার ভয় করে। ভীষণ ভয় করে। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আশে শীতল স্রোত। আমি তখন মনে মনে তাঁকে ডাকি। আর কি আশ্চর্য! আমি ডাকলেই রবীন্দ্রনাথ এসে আমার হাত ধরেন। অন্তরের আলোই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সেই যাত্রাপথ। নক্ষত্ররাজি বিরাজ করতে থাকে আকাশে। আলোই উদ্ভাসিত সেই অনন্ত যাত্রা পথে রবীন্দ্রনাথ আমাকে হাত ধরে পথ দেখান।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.