প্রবীর রায় : অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক, কলকাতা, ২৮ নভেম্বর ২০২১। আমি ভাগ্যবান , এই মানুষটার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ পেয়েছিলাম । আমার তখন ৮ / ৯ বছর বয়স। আমার দিদিমা ইন্দুলেখা চৌধুরীর সঙ্গে উত্তরায়ণে গিয়ে রথীন ঠাকুর আর প্রতিমা দেবীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা বলা যেতে পারে।
গুরুদেবের পাশের ওই ব্যক্তিটির একক ছবি দিয়েও আজকের এই পোষ্ট দেওয়া যেত। হয়তো সেটা সঙ্গতও হত। কিন্তু ওই ব্যক্তিটি নিজের জীবনে নিজেকে কখনই ‘রবীন্দ্রনাথ’ থেকে পৃথক করে ভাবেননি। বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শ, পরিকল্পনা, চিন্তাভাবনা, এই সব কিছুকেই সফলভাবে রূপায়ণ করাকেই নিজের জীবনের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য ও দায়িত্ব হিসাবে মাথায় তুলে নিয়েছিলেন ওই মানুষটি। আজীবন কাল তিনি নিজেকে নিভৃতে রেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মকাণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কারণ তিনি নিজেও যে ছিলেন যথেষ্ট গুণের অধিকারী। বাংলা ইংরেজি দু’ভাষাতেই চমত্কার লিখতেন, ছবি আঁকতেন, কাঠের কাজ আর উদ্যানচর্চায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কৃষিবিজ্ঞানের ভাল ছাত্র, খেলাধুলোয় উত্সাহী, সংগঠনি ক্ষমতা ছিল যথেষ্ট। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় কসমোপলিটান ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই ক্লাবের বেসবল টিমের তিনি উত্সাহি উদ্যোক্তা। আর এত সবকিছু পরেও যা পড়ে থাকে, যেটা সবথেকে বড় পরিচয়, ওঁর পিতার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আর এইখানেই এসে পড়ে তাঁর উপরে এক বিশাল চাপ। প্রত্যাশার চাপ। এমনকী জন্মের আগে থেকেই তাঁর উপরে এসে পড়েছিল এই চাপ। বিখ্যাত বাবা আর সুখ্যাত পরিবারের সন্তান হওয়ার যে কী জ্বালা!
পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা আর আনুগত্যের কারণে তাঁর নিজের সমস্ত গুণ এবং বিদেশের গবেষক জীবনের ভবিষ্যত্ ফেলে পিতার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর জন্য কত কিছু যে করেছেন!
পিতার আদর্শকে রূপ দিয়ে যখন সফলকাম হয়েছেন তখন সমস্ত প্রশংসা আর অভিনন্দনের মালায় অভিনন্দিত হয়েছেন কবি। কিন্তু যখন ব্যর্থ হয়েছেন তখন সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে নতমুখে সরে গিয়েছেন কবিপুত্র – এমনকি সে-ব্যর্থতায় নিজের ত্রুটি না থাকলেও।
আজীবন নিভৃতচারী এই মানুষটির গতকাল ছিল জন্মদিন। আমরা ক’জনই বা খবর রাখি, আজ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৮৮-১৯৬১) জন্মের ১৩৩ বছর। যদিও তিনি কবিপুত্র, বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য।
পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদপ্রান্তে ছড়ানো ছিল পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিঃশব্দ সেবার ডালি। বলাবাহুল্য সেই মহান সেবা যদিও পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশে উত্সর্গীকৃত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা যে মানব-ইতিহাসের কাছেই নিবেদিত – তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না॥
Be First to Comment