স্মরণঃ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লিখতে গিয়েছিলেন আত্মজীবনী, হয়ে উঠল ‘পিতৃস্মৃতি’। রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনটি ছিল এমনই পিতৃকেন্দ্রিক। তিনি ছিলেন নীরবকর্মী, মুখচোরা মানুষ। পিতৃচিন্তা এবং পিতার দেওয়া দায়িত্ব নিষ্ঠা ভরে পালন করাই ছিল তাঁর প্রধান কর্তব্য। সেই কর্তব্যের মাঝে চাপা পড়ে গেছে তাঁর শিল্পী-সাহিত্যিক-বৈজ্ঞানিক মনটি। কমে গেছে সৃজনশীলতার সময়।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৭ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে কলকাতার জোঁড়াসাকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মৃণালিনী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য।
১৯১০ সালে রথীন্দ্রনাথ শেষেন্দ্রভূষণ ও বিনোদিনী দেবীর বিধবা কন্যা প্রতিমা দেবীকে বিবাহ করেন। এই বিবাহই ছিল ঠাকুর পরিবারের প্রথম বিধবা বিবাহ।
রথীন্দ্রনাথ চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতেন। হতে পারতেন সাহিত্যিক। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই নির্মেদ, প্রাঞ্জল, সাবলীল ও সুললিত গদ্য লেখার দক্ষতা তাঁর ছিল।
তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হল : ‘প্রাণতত্ত্ব’ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), ‘অভিব্যক্তি’ (১৩৫২ বঙ্গাব্দ)। অশ্বঘোষ রচিত বুদ্ধচরিত গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ, ‘অন দ্য এজেস অফ টাইম’ (১৯৫৮)। পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে লেখেন ‘পিতৃস্মৃতি’।
রান্নায় অসম্ভব পটু ছিলেন। শান্তিনেকতনে আসা বিদেশি অতিথি-অভ্যাগতদের জন্য নিজের হাতে জ্যাম-জেলি তৈরি করতেন। প্রয়োজন পড়লে রান্না করতেন বিভিন্ন ধরনের স্বাদু পদ। সুগন্ধি পাউডার এবং ভালো সেন্ট তৈরি করতে পারতেন।
তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রদের একজন। ভালো করে সংস্কৃত শিক্ষা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। অত্যন্ত সুন্দর ও প্রাঞ্জল বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’। চামড়ার ওপর সুন্দর নকশা করতে পারতেন। আর জানতেন বাটিকের কাজ। শান্তিনিকেতনে এই দুইয়েরই প্রবর্তন হয় তাঁর হাত ধরে।
তিনি ছিলেন অসাধারণ এক দারুশিল্পী। নানা রঙের কাঠ সংগ্রহ করে, সেইসব কাঠের নিজস্ব রঙ অক্ষুন্ন রেখে খোদাই করে কত না অসামান্য শিল্পকর্ম করেছেন তিনি। আসবাবের অভিনব সব নকশা তৈরি করেছেন।
প্রথাগতশিক্ষায় স্থপতি না-হয়েও শান্তিনিকেতনের অজস্র বাড়ির নকশা তৈরি করেছেন। যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। তারপরও তিনি কৃষিবিজ্ঞানী হলেন রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেপূরণের জন্য।
মনে পিতৃবন্ধু জগদীশচন্দ্রের মতো বিজ্ঞানী হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, বাবার ইচ্ছেপূরণ করতে ছেলে বেশ আগ্রহ নিয়েই আমেরিকা গেলেন। কারণ, নতুন কিছু শিখতে, নতুন কিছু করতে রথীন্দ্রনাথের চিরকালই প্রবল আগ্রহ।
আমেরিকা থেকে ফিরে শিলাইদহে উন্নতমানের কৃষিযন্ত্রপাতি নিয়ে একটি কৃষিফার্ম গড়ে তুললেন। চাষিদের আলু, টমেটো আর আখের চাষ শেখালেন। মাটি পরীক্ষার জন্য ল্যাব তৈরি করলেন। শেখালেন ট্রাক্টরের ব্যবহার। নিজে ট্রাক্টর চালিয়ে তাদের জমি চাষ করে দিলেন।
এদিকে যখন এইসব কর্মকাণ্ড চলছে, তখন ওদিকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন। একা হাতে তা সামলাতে রবীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই ছেলেকে তিনি ডেকে নিলেন এই কর্মযজ্ঞে।
শান্তিনিকেতনে পিতার দেওয়া দায়িত্বভার মাথায় তুলে নিয়েও উদ্যানপালনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যে শান্তিনিকেতনের মাটিতে গোলাপ ফুটতে চাইত না, সেখানে তিনি হরেক রকমের গোলাপের বাগান করলেন। লতানো আমের আশ্চর্য এক বাগান তৈরি করলেন। তার সঙ্গে ছবি আঁকা-শিল্পচর্চাও অব্যাহত রইল। এরইসঙ্গে বিশ্বভারতীর জন্য তাঁর ত্যাগেরও অন্ত রইল না।
মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর রথীন্দ্রনাথের হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন একজোড়া চটিজুতো। সেই হল রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিসংগ্রহের সূত্রপাত। মৃণালিনী দেবীর পাণ্ডুলিপি, রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সাময়িকপত্রে প্রকাশিত রবীন্দ্রসম্পর্কিত লেখার কাটিং সংগ্রহ করে তুলে দিলেন বিশ্বভারতীর হাতে। নিজের জন্য বানিয়েছিলেন, নিজেরই নকশায় মনের মতন একখানা বাড়ি, ‘উদয়ন’।
রথীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন আজীবন এখানেই বাস করবেন। কিন্তু, করলেন না। তাঁর সেই প্রিয় বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সঙ্গে গড়ে তুললেন, রবীন্দ্র সংগ্রহশালা। খুলে দিলেন রবীন্দ্র-গবেষকদের জন্য।
রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ গানটি অনায়াসে ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর রথীন্দ্রনাথ নিজে গেলেন দিল্লি, নেহেরুর সঙ্গে দরবার করে গানটি জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত করে তবেই ফিরলেন বাংলায়। রচনা করলেন বাঙালির জন্য এক গৌরবের ইতিহাস।
রথীন্দ্রনাথ শেষ-জীবনে বিশ্বভারতীর দায়িত্ব ছেড়ে দেরাদুনে গিয়ে বাসা বেঁধেছিলেন। সেখানেই তিনি ১৯৬১ সালের আজকের দিনে (৩ জুন) ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment