Press "Enter" to skip to content

যারা ভালোবাসে— ভালোবেসে কাঁদে তাদের হয়ত অতি গোপন কথা রয়ে গেছে তাই লেখাগুলিকে ছিড়ে ফেলতে পারেননি কবি পূর্ণেন্দু পত্রী……..।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ পূর্ণেন্দু পত্রী

বাবলু ভট্টাচার্য : একদা কলকাতা নামের এক শহরে ৩১ বছরের এক যুবক ভালোবেসে ফেলেছিল ‘নন্দিনী’ নামের এক বিদ্যুত শিখাকে। নিদারুণ এই ভালোবাসার সঙ্গী ছিলেন কবি নিজেই। তাদের প্রাত্যহিক ভালোবাসার কথোপকথনগুলি লিখে রাখতেন তিনি। সেই শুভংকরের বয়স এখন ৪৫, সেই নন্দনী হয়ত বন্দিনি কোন এক সাজানো গৃহে। একবার ভেবেছিলেন তাদের সেই কথোকথনগুলি ছিড়ে ফেলে দেবেন। পরে ভাবলেন— না, যারা ভালোবাসে— ভালোবেসে কাঁদে তাদের হয়ত অতি গোপন কথা রয়ে গেছে এই লেখাগুলিতে। তাই লেখাগুলিকে ছিড়ে ফেলতে পারেননি কবি— তিনি কবি পূর্ণেন্দু পত্রী।

পিতা পুলিনবিহারী পত্রী, মা নির্মলা দেবী। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পারিবারিক কলহের কারণে পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। ১৯৪৯ সালে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ভর্তি হন বাণিজ্যিক শিল্পকলা বা কমর্শিয়াল আর্টের ছাত্র হিসেবে। যদিও নানা কারণে এই পাঠক্রম শেষ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

ছেলেবেলায় বাগনানের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা অমল গাঙ্গুলির সংস্পর্শে এসে কমিউনিস্ট পার্টির নানান সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কলকাতায় অভিভাবক কাকা নিকুঞ্জবিহারী পত্রীর চলচ্চিত্র পত্রিকা চিত্রিতা ও সাহিত্যপত্র দীপালি-তে তাঁর আঁকা ও লেখার সূচনা হয়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হয়ে পড়লে রাজনীতি ও সাহিত্যচর্চা উভয়েই একসঙ্গে চালাতে থাকেন।

১৯৫১ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ একমুঠো রোদ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস দাঁড়ের ময়না মানিক পুরস্কার লাভ করে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল শব্দের ঠিকানা (১৯৭৫), সূর্যোদয় তুমি এলে (১৯৭৬) আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা (১৯৮০) ও গভীর রাতের ট্রাঙ্ককল (১৯৮১), আমিই কচ আমিই দেবযানী ইত্যাদি। সাহিত্য গবেষক শিশিরকুমার দাশ তাঁর কাব্য সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ছন্দের কৌশল, প্রতিমা গঠনের স্পষ্টতা এবং কথনভঙ্গির ঘরোয়া চাল তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। পূর্ণেন্দু পত্রীর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভোমরাগুড়ি, মালতীমঙ্গল ইত্যাদি। রূপসী বাংলার দুই কবি তাঁর একটি বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ।

পূর্ণেন্দু পত্রী কলকাতা সম্বন্ধে প্রায় এক ডজন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শহর কলকাতার আদি পর্ব, বঙ্গভঙ্গ, কি করে কলকাতা হল, ছড়ায় মোড়া কলকাতা, কলকাতার রাজকাহিনী, এক যে ছিল কলকাতা ইত্যাদি। জীবনের শেষপর্বে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এক বিশাল গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে ১৯৯৬ সালে তার প্রথম খণ্ড বঙ্কিম যুগ প্রকাশিত হয়।

শিশুসাহিত্যেও তিনি ছিলেন এক জনপ্রিয় লেখক। ছোটোদের জন্য লিখেছেন আলটুং ফালটুং, ম্যাকের বাবা খ্যাঁক, ইল্লীবিল্লী, দুষ্টুর রামায়ণ, জুনিয়র ব্যোমকেশ, জাম্বো দ্য জিনিয়াস প্রভৃতি হাসির বই। আমার ছেলেবেলা নামে তাঁর একটি স্মৃতিকথাও রয়েছে। সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বিদ্যাসাগর পুরস্কারে ভূষিত করেন।

১৯৬৫ সালে প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প অবলম্বনে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘স্বপ্ন নিয়ে’ মুক্তি পায়। এর পর রবীন্দ্রনাথের কাহিনি অবলম্বনে ‘স্ত্রীর পত্র’ ও ‘মালঞ্চ’ সহ পাঁচটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন তিনি। এছাড়াও নির্মাণ করেন সাতটি তথ্যচিত্র। ‘স্ত্রীর পত্র’ চলচ্চিত্রটির জন্য তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনির্মাতা ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে সমরেশ বসুর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত তাঁর ‘ছেঁড়া তমসুক’ চলচ্চিত্রটিও একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল।

সাহিত্য ও চিত্রপরিচালনা ছাড়াও পূর্ণেন্দু পত্রী অন্যতম পরিচয় প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে। বাংলা সাহিত্যের শতাধিক ধ্রুপদী গ্রন্থের প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছিলেন তিনি। তাঁর অঙ্কিত প্রচ্ছদচিত্রগুলি গুণমানে ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিশেষ স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার।

১৯ মার্চ ১৯৯৭ সালে ৬৬ বছর বয়সে পূর্ণেন্দু পত্রী কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

পূর্ণেন্দু পত্রী ১৯৩১ সালের আজকের দিনে (২ ফেব্রুয়ারি) পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার নাকোলে জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *