Press "Enter" to skip to content

মেহেদী হাসান তখন মৃত্যুশয্যায়, তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন বাঙালি অভিনেত্রী ঝর্ণা বসাক…..।

Spread the love

এক বিস্মৃত নায়িকা ||?

প্রবীর রায় :  বিশিষ্ট চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা। মেহেদী হাসান তখন মৃত্যুশয্যায়, তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন এক বাঙালি অভিনেত্রী । দেখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল পক্ষাঘাতগ্রস্ত গজল সম্রাটের মুখ৷ বহুদিনের চেনা ওই মুখ তিনি ভোলেননি, বোঝাই গেল৷ আর করাচিতে তাঁর বাড়িতে চার পাশের লোকদের মুখে সম্ভ্রম ঠিকরে বেরোচ্ছিল অভিনেত্রীর রাজকীয় ভঙ্গি দেখে৷

পাকিস্তানে তাঁকে নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই । কত রঙ্গিন সব অনুষ্ঠান । টিভিতে তাঁকে দেখে পাকিস্তানি আম জনতা হামলে পড়ে । হারিয়ে যাওয়া কোনও সুপারস্টার যেন আবার হাজির চোখের সামনে৷ গত বছরে তিনি পাকিস্তানে যাওয়ার পর যখন বলেছেন, ‘আমি আবার অভিনয় করতে চাই’ তাঁর জন্য উপচে পড়েছে প্রস্তাব, পাক রেডিওতে বিশেষ খবর বলা হয়, আবার পাকিস্তান সিনেমায় নামছেন তিনি ৷ ললিউডে (পাকিস্তানি ফিল্মি দুনিয়া) নাকি শুটিং শুরু হবে ক’দিন পরে ৷ এই বাঙালি নায়িকার নাম কি কেউ জানে ?
সুচিত্রা, সাবিত্রী, মাধবী , সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে তখন উদ্বেলিত কলকাতা । এঁকে নিয়ে কোথাও কোনও কাগজে লেখা নেই এপার বাংলায় ।

পাকিস্তানি সিনেমায় সুপারস্টার একজন বাঙালি অভিনেত্রী !! ব্যাপারটার থেকে কম রোমাঞ্চকর আর কী হতে পারে?
এ পারের বাঙালিরা তাঁকে না চিনুক, তাতে কিছু এসে যায় না ঝর্ণা বসাকের, আন্তর্জাতিক সীমানার বাধা পেরিয়ে তিনিই প্রথম বাঙালি সুপারস্টার…. হয়তঃ বা শেষও ৷ সীমান্তের কাঁটাতার তাঁর সাফল্যে বাধা হতে পারেনি !

ঝর্ণা বসাক, ঢাকার এক ফুটবল রেফারি ননী বসাকের মেয়ে ৷ পাকিস্তানের কাগজে আজও তাঁকে নিয়ে যা চর্চা হয়, তা দেখলে বলিউড- টলিউডের তৎকালিন অভিনেত্রীরা অবাক হবেন ! ভাববেন কত ভাগ্যবতী ঝর্ণা, আজও খবরের শিরোনামে ৷ ঝর্ণা বসাক পাকিস্তানের ললিউডে অন্তত ১৫২ উর্দু সিনেমায় অভিনয় করেছেন সঙ্গে ৪ টে পাঞ্জাবি সিনেমা ৷ ষাটের দশক থেকে আশির দশক, মানে বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার পরেও রাজত্ব চালিয়ে গিয়েছেন সেখানে ৷ যখন দুটো দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক চরম তিক্ত, তখনও ভালোবাসা কুড়িয়েছেন ওয়াঘার ও পারে৷ পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা অভিনেত্রী । আমাদের এখানে যেমন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, পাকিস্তানে তেমন নিগাঢ় পুরস্কার ৷ ঝর্ণা সেরা নায়িকার স্বীকৃতি পেয়েছেন ১৩ বার ৷ পাকিস্তানে আর কোনও নায়িকা এতবার এই স্বীকৃতি পাননি ৷

পাকিস্তানে এই ঝর্ণা বসাক পরিচিত ‘শবনম’ নামে ৷
শবনমের কাছে অন্য বাঙালি অভিনেত্রীরা কোথায় লাগে? কোনও বাঙালি নায়িকাই আর এই নজির গড়তে পারবেন বলে মনে হয় না৷ বাংলাদেশের অনেক বাঙালি অভিনেত্রীকে আমরা জানি | ববিতা, চম্পা, শাবানা, রেজিনা, সুছন্দা, অঞ্জু ঘোষ ৷ কিন্তু শবনমকে ব্যবহারই করল না দু’দেশের বাংলা সিনেমা । তাঁর জীবনই তো একটা সিনেমা !

১৯৬২ সালে করাচির নিশাত সিনেমা হলে ঝর্ণার প্রথম উর্দু সিনেমা রিলিজ করে ‘চন্দা’৷ পরিচালক এতেসামই ঝর্ণার নাম পাল্টে রাখেন ‘শবনম’৷ সিনেমাটা সুপারহিট হলেও নায়িকা ছিলেন অন্য এক জন, কিন্তু সবার দৃষ্টি কেড়ে নেন শবনম ৷
পাকিস্তানের ‘চকোলেট হিরো’ ওয়াহিদ মুরাদ পাকিস্তানের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রির সঙ্গে সরাসরি প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন ঝর্ণার ৷ ১৯৬৮ সালে ‘সমন্দত’ সিনেমায় প্রথম পাক যাত্রা শুরু৷ বাংলাদেশ যুদ্ধ যখন শুরু, তার অনেক আগেই রবীন আর ঝর্ণা করাচিতে ডেরা বাঁধলেন ৷ তার পর এত সিনেমা, এত নানা বৈচিত্র্যময় চরিত্র, কোনও সমস্যা হয়নি ৷ করাচিতে প্রথম কয়েক যুগ কাটানোর পর তাঁরা সংসার পাতেন লাহোরে ৷ পাকিস্তানে এই দম্পতির দুটো অধ্যায় দুটো শহরে৷

পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হল তখনও তাঁর আর নাদিমের জুটি পাকিস্তানে রাজ কাপুর-নার্গিস, ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনী, উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেনের জুটির মতো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে | শবমন-নাদিমের ‘আয়না’ পাক বক্স অফিসে সব রকম রেকর্ড ভেঙে দেয়, পাকিস্তানের একমাত্র ‘ক্রাউন জুবিলি’ ফিল্ম এই আয়না ৷ করাচির দুটো সিনেমা হল ‘ব্যাম্বিনো’ ও ‘স্কালা’তে মুক্তি পায় চলে টানা ৪৮ সন্তাহ ৷ গোটা দেশে সব মিলিয়ে ৪০১ সন্তাহ চলেছিল ৷ এখনও সেই রেকর্ড ভাঙতে পারেনি কোনও পাক ছবি ।

১৯৭৭ সালে এক বাঙালি অভিনেত্রীকে নিয়ে পাকিস্তান সিনেমা জগৎ তোলপাড় , সেই ছবি চলছে চিনেও ৷ পাকিস্তানে ১২ টি পুরস্কার জিতে ফেললো সেই ছবি। মেহদি হাসানের গলায় ‘মুঝে দিল সে না ভুলানা’ পাকিস্তানের যেন জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল ৷ মেহদি হাসানের মৃত্যুর আগে শবনম যখন পাকিস্তানে গিয়ে তাঁর হাতে ফুল দিচ্ছেন, তখনও পাক টিভিতে ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজেছে ‘মুঝে দিল সে না ভুলানা’৷

বাঙালি রেফারির মেয়ে উর্দু সিনেমা মাতিয়ে দিয়েছিলেন দুটো কারণে ৷ অভিনয় প্রতিভা এবং বৈচিত্র্যে ৷ এখনও পাকিস্তানের লোকেরা ভোলেনি তাঁর অভিনীত নানা চরিত্র । সিনেমায় ব্যবহার করা ঝর্ণার সব শাড়ি যেত ভারত থেকে , পাঠাতেন তাঁর মা ও বোন ৷

১৩ ই আগস্ট, ১৯৭৮, লাহোরের গুলবার্গের বাড়িতে স্বামী এবং পুত্র রনি’র সামনেই পাঁচ জন অতিপ্রভাবশালী নেতার বন্দুকধারী ছেলেদের দ্বারা গণধর্ষিতা হলেন গ্ল্যামার গার্ল শবনম। ডাকাতিও হলো | পুলিশ দুষ্কৃতীদের নামে ডাকাতির মামলা নিলেও গণধর্ষণের অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। অবিলম্বে পাকিস্তান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় পুরো পরিবার। প্রেসিডেন্ট জিয়া-উল-হক ব্যক্তিগত ভাবে পাকিস্তানে না ছাড়ার অনুরোধ করেছিলেন । কিন্তু আর পিছন ফিরে তাকান নি পোস্টার গার্ল। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে উঠল দুষ্কৃতীদের ফাঁসি দেওয়ার আওয়াজ । বাধ্য হয়ে কেস ওঠে পাকিস্তানের বিশেষ মিলিটারি আদালতে 412 PPC বিশেষ ধারাতে । পাঁচজনেরই ফাঁসির আদেশ হয় । সহায়তাকরি বাকি দুজনের একজনের হয় দশ বছর কারাদণ্ড, ছাড়া পেয়ে যায় আর একজন, অন্যতম মূল অভিযুক্ত ফারুক বাদিয়াল প্রভাব খাটিয়ে । যে পরবর্তীকালে যোগ দেয় ইমরানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টিতে । ঝড় ওঠে সোশ্যাল মিডিয়াতে । দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন ইমরান খান । দূর করে দেন ফারুক কে।

১৯৯০ সালে পাকাপাকি ভাবে পাকিস্তান ছেড়ে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার পরেও তাঁর অনেক সিনেমা রিলিজ হয় পাকিস্তানে ৷ দাপট সত্যি একেই বলে! আমাদের বলিউডে হেমা মালিনী, নার্গিস, মধুবালাদের ক্ষেত্রে যেমন গল্প শোনা যেত ৷
ঝর্ণা বসাকের অন্যতম শক্তি ছিলেন স্বামী রবিন ঘোষ ৷ তিনি নিজে এক বিখ্যাত সুরকার ৷ পাক সঙ্গীত জগতের লোকেরা এক ডাকে তাকে চেনে ৷ অনেক ভালো ভালো সিনেমায় সুর রয়েছে তাঁর ৷ পাকিস্তানের ঐতিহাসিক ছবি ‘আয়না’ তে সুর রবিনেরই ৷ পাঁচের দশকে ঢাকায় রেডিওতে রবীনকে কাজের প্রস্তাব দেন তাঁর এক বন্ধু ৷ সেই বন্ধুর বোনই ঝর্ণা ৷ তারপর তাঁদের প্রেম এবং বিয়ে৷ রবীন ছিলেন বাঙালি খ্রিস্টান, ঝর্ণারা বাঙালি বৌদ্ধ পরিবারের ৷
নিজের দেশ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর একেবারে অন্যরকম পরিবেশে গিয়ে ঝর্ণা যে রাজত্ব করেছেন, তাঁর পিছনে রবীন । 2016 এর ফেব্রুয়ারিতে প্রয়াত হন রবীন ৷

এই ঘটনা আর একবার দেখিয়ে দিয়ে যায়, শিল্প সংস্কৃতির কাছে শেষ পর্যন্ত ঠিক হেরে যায় রাজনীতি৷ কেন যে এইসব কাহিনী ভালো করে প্রচার হয় না?
সুপারস্টার ঝর্ণা বসাককে তো আমরা এপারের বাঙালিরা চিনলামই না ! ‌

তথ্য: নয়া দৌড় ।- সংগৃহীত

More from EntertainmentMore posts in Entertainment »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.