ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ৩ মার্চ, ২০২৫।
রজঃস্রাব বা ঋতুচক্র মহিলাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ৷ মোটামুটিভাবে প্রতি মাসে ( ২১-৩৫ দিনে )একবার শারীরবৃত্তীয় এই প্রক্রিয়াটি ১৪ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত চলমান থাকে ৷ তবে বর্তমান সময়ে স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের ১০-১১ বছর বয়স থেকেই ঋতুচক্র শুরু হয়ে যায়। ঋতুচক্রের মধ্যবর্তী সময়ে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হয় ৷ যৌনমিলনের সময় এই ডিম্বাণু শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হলে তা থেকে জাইগোট> ভ্রুণ> সন্তান হয় ৷ নির্দিষ্ট বয়সের পর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা আর থাকে না ৷ রজঃস্রাব হয় না ৷ বন্ধ হয়ে যায় ডিম্বাণু নিঃসরণ ৷ এই সময়টাকে বলে রজঃনিবৃত্তি বা মেনোপজ ৷ এই প্রক্রিয়া হতে কয়েকবছর লেগে যায় ৷ প্রজনন ক্ষমতা বন্ধের এই সময়কাল হল Climacteric .মেনোপজ কোন রোগ নয় একটি প্রকৃতিগত বিষয় ৷ পৃথিবীতে মেনোপজের গড় বয়স ৫১ হলেও আমাদের মত দেশে ৪৫-৪৬ বয়সেই অধিকাংশ মহিলার মেনোপজ হয়ে যায় ৷ ডায়াবেটিস , থাইরয়েড , অতিরিক্ত ধূমপান , মদ্যপান , এন্ডোমেট্রিয়োসিস ও পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যায় ( PCOS) আগেও মেনোপজ হতে পারে ৷ এছাড়া কোন কারণে ডিম্বাশয় কেটে বাদ দিলে মেনোপজ হয় ৷ যাকে বলে সার্জিক্যাল মেনোপজ ৷ মেনোপজ শুরুর প্রথমদিকে ওভারি বা ডিম্বাশয় দুটি ইস্টোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন ধীরে ধীরে কমিয়ে দেওয়ায় অনিয়মিত রজঃস্রাব হতে হতে সাধারণভাবে মেনোপজ হয় ৷ ৪০ বছর বয়সের আগে ডিম্বাশয় হরমোন তৈরী করতে না পারলে ১% ক্ষেত্রে প্রিম্যাচিউর ওভারিয়ান ইনসাফিশিয়েন্সি হতে পারে ৷
রজঃনিবৃত্তির পর মহিলাদের জীবনে বেশ শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা যায় ৷ এগুলি একেকজনের ভিন্ন ভিন্ন এবং কষ্টও একেকরকম হয় ৷যেমন – গরম বোধ বেড়ে যাওয়া , রাতে প্রচুর ঘাম , অস্থির লাগা , মাথা ঘোরা , মাথা ব্যথা , ক্লান্ত ও অবসন্ন লাগা , স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া , মনোযোগের অভাব , মেজাজ খিটখিটে হওয়া , যোনিপথ শুকিয়ে যাওয়া বা ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস ও পাতলা হয়ে যাওয়া , হাত ও পায়ের তালু জ্বালা , কান -মাথা গরম হওয়া , উচ্চরক্ত , খারাপ কোলেস্টেরল বা চর্বি বাড়া , হৃদরোগের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাওয়া , হাড়ের ক্ষয় বাড়া , ওজন বেড়ে যাওয়া , মেটাবলিক সিনড্রোম , প্রস্রাবের সমস্যা , ত্বকের পরিবর্তন , মানসিক অসুবিধা এসব হতে পারে ৷ এজন্য ব্যায়াম ও কাজের মধ্যে থাকা দরকার ৷ উচ্চ প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম যুক্ত খাদ্য খেতে হবে , গরম এড়িয়ে চলতে , সিন্থেটিকের বদলে সুতির কাপড় পরা উচিত ৷ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন ৷ ধূমপান সহ নানা ধরণের নেশা থেকে দূরে থাকুন ৷ তিসি , তিল বীজ , মটরশুঁটি , টোফু , সয়াবিন ইত্যাদি খাবার উপকারী ৷ নিজেকে প্রফুল্ল রাখতে হবে ৷
মহিলাদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার কথা ভেবে ২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক মেনোপজ কমিটি( IMS) অক্টোবর মাসকে বিশ্ব মেনোপজ সচেতনতা মাস এবং ১৮ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক মেনোপজ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়৷
সেই থেকে প্রতি বছর বিশেষ থিমে দিনটি সারা পৃথিবীতে উদযাপিত হচ্ছে ৷ ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় হল ” Cognition & Mood” . Cognition মানে চিন্তা , যুক্তি ও জ্ঞানের মাধ্যমে অনুধাবন করা ৷ Mood এবং Emotion হল প্রসন্নতা , বিষন্নতা, ক্রোধ ও ভয়ের ব্যাপার ৷ ভালো থাকার হরমোন Dopamine যার নিয়ন্ত্রক ৷২০২০ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ” প্রি ম্যাচুউর ওভারিয়ান ইনসাফিশিয়েন্সি”৷ গতবছর ছিল “হাড়ের স্বাস্থ্য “৷ এভাবে মেনোপজ হওয়া নারীদের মধ্যে এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সঙ্গে খোলামনে আলোচনার ব্যবস্থা করা ৷ নিজেদের উপসর্গ কমিয়ে সহযোগিতার গ্রুপ তৈরী করে একে অপরকে সহায়তা করা এই দিন ও মাস পালনের মূল লক্ষ্য ৷ পৃথিবী জুড়ে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে ৷ আমাদের দেশেও তা ইতিমধ্যে সত্তর পেরিয়েছে ৷ তাই , বয়স্ক মহিলাদের এই সমস্যা আরো বেশী করে সমাজ ও পরিবারকে ভোগাচ্ছে ৷ মেনোপজে এলোপ্যাথি মতে এন্টিডিপ্রেসেন্ট প্যারোক্সেটিন , স্নায়ুর ওষুধ গ্যাবাপেন্টিন , যোনি শুষ্কতায় ইস্ট্রোজেন ও লাগানোর লুব্রিকেন্ট বা ময়েশ্চারাইজার , গরম ফ্ল্যাসের জন্য সিলেক্টিভ ইসস্ট্রোজেন রিসেপ্টর মডুলেটর , হাড় মজবুত রাখতে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট চিকিৎসক বুঝে দেন ৷ পেলভিক ফ্লোরের পেশী শক্তিশালী করতে কেগেল ব্যায়াম ও যোগাসান বেশ কাজে আসে ৷ মেনোপজের বিভিন্ন সমস্যার উপর লক্ষণভিত্তিক রোগী অনুযায়ী বেলেডোনা , সালফার , ল্যাকেসিস , সিপিয়া , গ্লোনয়িন , ইগ্নেশিয়া , লিলিয়াম টিগ , নেট্রাম মিউর , স্ট্যাফিসসেগরিয়া , পালসেটিলা ইত্যাদি হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খুব ভালো কাজ দেয় ৷প্রয়োজনে ওষুধ কিংবা হরমোন( MHT) চিকিৎসা করতে হবে ৷আগামীতে জিন চিকিৎসা বিজ্ঞানকে চরম লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। নারী দিবসের প্রাক্কালে এই প্রতিবেদনটি নারীদের কথা ভেবেই লেখা।
ছবি সৌজন্যে- গুগুল।
Be First to Comment