Press "Enter" to skip to content

মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র-দর্শনে ’শান্তির’ কোনো স্থান ছিল না। কেননা এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ মানুষের শান্তি- সম্মানজনক জীবন অসম্ভব…..!

Spread the love

স্মরণ : মৃ ণা ল সে ন

বাবলু ভট্টাচার্য : কখনো প্রবল অস্বস্তি, কখনো মস্তিষ্কে বিস্ফোরণ, কখনো দ্রোহের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু কখনো বিনোদন নয়। মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র-দর্শনে ’শান্তির’ কোনো স্থান ছিল না। কেননা এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ মানুষের শান্তি- সম্মানজনক জীবন অসম্ভব, সিনেমা জীবনের বাইরে দিয়ে কল্পলোকের কথন হবে না, এমনই ভাবতেন, বলতেন, ক্যামেরায় ফুটিয়ে তুলতেন মৃণাল সেন।

১৯২৩ সালের ২৪ মে মৃণাল সেন ফরিদপুরে জন্ম নেন। বাবা দীনেশ সেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন। মৃণাল সেনের পরিবার রাজনৈতিক পরিবার। তাই অতি শৈশব থেকেই রাজনৈতিক পরিবেশে মানুষ হয়েছেন।

চলচ্চিত্রে এসেছিলেন বই পড়তে পড়তে। নানা ধরনের বই পড়ার অভ্যাস ছিল তার। এই বই পড়তে পড়তে একদিন রুডলড় আরনেইসের ‘ফিল্ড অ্যান্ড আর্ট’ পড়ে এতটাই ভালো লাগল যে ফিল্মের নন্দনতত্ত্বের ওপর প্রাথমিক ধারণা জন্মাল তখনই। হাতে এল নিলসনের ‘সিনেমা ইজ এ গ্রাফিক আর্ট’। এই বই পড়ে সোভিয়েত পরিচালক আইজেনস্টাইনের সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে তার জ্ঞান লাভ হয়েছিল।

আরও জানার জন্য তিনি আইজেনস্টাইনের ‘ফিল্ম ফর্ম অ্যান্ড ফিল্ম সেন্স’ পড়ে ফেলেন। এই বইগুলো পড়ার পর তার ফিল্ম দেখার আগ্রহ হয়। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি যে সব বিদেশি ধ্রুপদি ছবি দেখাত, সেগুলো দেখতে থাকেন। এই সময় জঁ রেনোয়া কলকতায় ছবি করতে আসেন। মৃণাল সেনের অনেক বন্ধু রেনোয়ার সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। সেই সুবাদে রেনোয়ার ছবির শুটিং দেখতে যেতেন।

তার প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ (১৯৫৫)। উত্তমকুমার অভিনয় করলেও এই ছবিকে নিজেই তেমন পছন্দের তালিকায় রাখেননি মৃণাল সেন। দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নিচে’ (১৯৫৮), দর্শক প্রশংসিত ছবি। কিন্তু তার নিজের ধারণায় ছবিটির নির্মাণে কিছু খামতি ছিল। পরের ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০)।

মৃণাল সেনের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিটিতে। সামাজিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক এই ছবিতে দেখানোর প্রচেষ্টা হয়েছে। ছবিটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়। ভূয়সী প্রশংসাও কুড়োয় এই ছবিটি। ফরাসি সমালোচক জর্জ শাদুরেলর মতে- ‘এই ছবিটি একটি বৈপ্লবিক ছবি’। এই ছবির পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

১৯৬৯-তে ‘ভুবন সোম’। সব দিক থেকেই এই ছবি এক নতুন দিগন্ত। নিউ সিনেমা আন্দোলনের প্রবাহে তৈরি এই ছবি মৃণাল সেনের প্রথম হিন্দি ছবি। নায়িকা সুহাসিনী মুলের প্রথম অভিনয়। অমিতাভ বচ্চনের প্রথম ভাষ্য পাঠ এবং কে কে মহাজনের প্রথম ক্যামেরা।

রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ত্রয়ী’– ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ‘৭১ (১৯৭২), পদাতিক (১৯৭৩)। সাত দশকের সেই সময়ের অস্থিরতা, সমাজে গভীর ভাঙন, ছিন্নভিন্ন মধ্যবিত্ত জীবন কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে না যাওয়ার ভেদ–নজিরবিহীন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সিনেমার ভাষায়।

চেনা জীবনের মধ্যে নিহিত থাকা অনিশ্চয়তা, সংকীর্ণতা, শ্রেণি দূরত্ব ফুটিয়ে তুলেছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯), ‘খারিজ’ (১৯৮২) এ। বিশেষ করে এই দুই ছবি ছুরির ফলার মতো বিদ্ধ করেছে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধকে। ‘মৃগয়া’য় মিঠুন চক্রবর্তীকে সামনে এনেছিলেন।

‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০) তৈরি হয়েছিল ছবির মধ্যে ছবির কাঠামোয়। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরকে বিষয় করে ছবি তুলতে আসা দল দেখেছে সমকালীন গ্রামিণ দুর্দশার ছবি। ওড়িয়া ভাষায় করেছিলেন ‘মাটির মনিষ’, তেলেগু ভাষায় ‘ওকা উরি কথা’। ‘খণ্ডহর’, ‘মহাপৃথিবী’-তে মানবিক মূল্যবোধের কথা বলেছিলেন। শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ‘আমার ভুবন’ (২০০২)। পূর্ণাঙ্গ কাহিনি চিত্রের বাইরে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, তথ্যচিত্র করেছেন একের পর এক।

মৃণাল সেন জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন চারবার। ‘ভুবন সোম’ শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে এবং ‘পুনশ্চ’, ‘আকাশকুসুম’, ‘অন্তরীণ’। শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার ‘ভূবন সোম’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘আকালের সন্ধানে’ এবং ‘খণ্ডহর’ -এর জন্য। আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন বহুবার।

দেশ-বিদেশের বহু চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি বিচারকের ভূমিকা পালন করেছেন।

দাদাসাহেব ফালকে, পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত মৃণাল সেন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ছিলেন।

১৯৬৮ থেকে ২০০৩ ছিলেন রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য।
বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের বহু প্রতিবাদী কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিয়েছেন। অন্যায়, গণতন্ত্রের ওপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তির জগতের সমবেত প্রতিবাদে প্রায়ই তিনি ছিলেন অগ্রণী।

১৯৫২ সালে গীতা সোমের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। গীতা সেন ছিলেন দক্ষ অভিনেত্রী। তাদের পুত্র কুণাল। ২০১৭ সালের গীতা সেনের জীবনাবসানের আঘাত ছিল খুবই তীব্র।

মৃণাল সেন ২০১৮ সালের আজকের দিনে (৩০ ডিসেম্বর) কলকাতায় নিজ বাড়িতে পরলোক গমন করেন।

More from CinemaMore posts in Cinema »
More from EntertainmentMore posts in Entertainment »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.