ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : ১০ অক্টোবর ২০২১।
ব্রহ্মার কাছে মহিষাসুর অমরত্ব বর চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন ৷ তখন মহিষাসুর বলেন তাঁকে যেন দেব ,দানব বা অসুরদের কেউ বধ করতে না পারে ৷ ব্রহ্মার বরের মধ্যেই ছিল ফাঁক ৷ বলা ছিল না তাঁকে বধিতে পারে একজন নারী ৷ যিনি মানব শরীর থেকে সৃষ্ট নন ৷ জন্ম দেবতার তেজ থেকে ৷ তাই , বিষ্ণু সহ দেবতারা মিলিত শক্তির দ্বারা নারী অর্থাৎ দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করলেন ৷ তাঁর মুখ মন্ডলে শিবের তেজ , বাহু দ্বয়ে বিষ্ণুর , দুই পায়ে ব্রহ্মার , পায়ের দশ আঙুলে সূর্যের , ত্রিনয়নে অগ্নি দেবের ও কান দুটিতে এলো বায়ুর তেজ। যাঁর দু দিকের দশ হাতে তাঁরা অস্ত্র তুলে দিলেন ৷ অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য তিনি দশ প্রহরণধারিনী ৷
দশ হাতে তিনি পূর্ব , পশ্চিম , উত্তর , দক্ষিণ , ঈশান , বায়ু ,
অগ্নি , ণৈঋত , ঊর্ধ ও অধঃ এই দশ দিক রক্ষা করেন ৷ ত্রৈম্বক্যে বা ত্রিনয়না দেবীর ডান চোখ সূর্য যা কর্মের , বাঁ চোখ চাঁদ বা বাসনা এবং মাঝের চোখ অগ্নি বা জ্ঞানের প্রতীক ৷ মা দুর্গার প্রধান অস্ত্র “ত্রিশূল”৷ যা ত্রিকাল দন্ড ৷ মহাদেব দিয়েছিলেন ৷ আমরা জানি ত্রিশূল ত্রিগুণ সত্বঃ বা দেবগুণ ৷ যা ত্যাগ , নিরহংকার , ও অলৌকিকত্বের প্রকাশ ৷ তেমনি রজঃ গুণ জীব কুল তথা মানব গুণ ৷ মোহ ও মায়া , দুঃখ , কাম ,শোক ও লোভ দ্বারা জর্জরিত ৷ আর একটি হলো তমঃ বা ঋণাত্মক গুণ ৷ যা রাক্ষস কুলে থাকে ৷
ক্রোধ , লোভ , মিথ্যা , প্রতারণা , হত্যা , চুরি , বিলাসিতার মত অপরাধ মূলক কাজের আধার ৷ ত্রিগুণাতীত হলো ত্রিশূল ৷ মাঝের ফলাটি সত্বঃ গুণ এবং বাকী দুটি রজঃ ও তমঃ গুণকে বোঝায় ৷ প্রকৃত মানুষের লক্ষ্য সত্বঃ গুণের বিকাশ সাধন ৷ ত্রিশূলের স্মরণে ত্রিগুণ থেকে মুক্তি লাভ হয় ৷ বরুণ দেব দেন “শঙ্খ” বা শাঁখ ৷ দুর্গার বাঁ হাতের শাঁখ হলো জাগরনের ও সৃষ্টির প্রতীক ৷আমরা জানি পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম বিকাশ জলে ৷ শাঁখ সামুদ্রিক জলজ শামুক গোত্রীয় প্রাণী ৷ শাস্ত্র মতে সৃষ্টির সূচনায় যখন সব কিছু জলমগ্ন ছিল ৷তখন বিষ্ণুদেব সাগরের নিচে শাঁখের আধারে ছিলেন ৷জগন্মাতা পঞ্চভূতের একত্রিত শক্তির প্রকৃতি স্বরূপ ৷তাই শাঁখ প্রাণ শক্তির উৎস হিসাবে চিহ্নিত ৷ যুদ্ধে শাঁখের আওয়াজ শত্রুকে সর্তক করে ৷ দেবীর ডান হাতের ” চক্র” ৷ পেয়েছিলেন বিষ্ণুর কাছে ৷ সু মানে সুন্দর ও দর্শন অর্থে দৃশ্যমান ৷ শাক্ত বিশ্বাসে দেবী আদ্যাশক্তি ব্রহ্মান্ড প্রসবিনী ও নিয়ন্ত্রন কত্রী ৷ জীব জগতের মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা বিরাজমানা ৷ চক্রের মত ব্রহ্মান্ড তাঁকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে ৷ ডান হাতের আরেক অস্ত্র খড়্গ বা “খাঁড়া” ৷
সিদ্ধিদাতা গণেশ তাঁকে খড়্গ দেন ৷ খড়্গ কিংবা তলোয়ার হলো বলি দানের অস্ত্র ৷ তাই , অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে বা ৪৮ মিনিটের সন্ধিপূজায় চামুন্ডা রূপী দেবীর কাছে বলি দেওয়া হয় ৷ বলি মানে পশু নয় পশুত্বকে বলি ৷ ষড় রিপুকে বলি দিলে আত্ম শক্তি পরিশুদ্ধ হয় ৷ আত্ম নিবেদন ও ত্যাগের মাধ্যমে এই বলি মোক্ষ বা মানব জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য মুক্তির পথ ৷এর ধার মগজাস্ত্রের বুদ্ধির ধার ৷মানুষের বুদ্ধির প্রতীক ৷ “গদা” বা কালদন্ড দেবীকে দিয়েছিলেন ধর্ম রাজ বা যম রাজ ৷ আমরা সনাতনীরা মনে করি শুভ ও অশুভ শক্তি মহাশক্তি দুর্গার নিয়ন্ত্রনাধীন ৷ দেবীর বাঁ হাতের এই অস্ত্র হলো সম্মোহনকারী শক্তি যা মহাপ্রীতি ও আনুগত্যের প্রকাশ করে ৷ ভালোবাসা ও ভক্তি প্রকাশ করে ৷ “তীর ধনুক” হলো লক্ষ্যভেদের অস্ত্র ৷পবন বা বায়ু দেবের দেওয়া এই আমাদের লক্ষ্য স্থির করে সত্যের পথ দেখায় ৷ ইতিবাচক শক্তির উৎস ৷ মানুষের শরীরের ভিতরের শক্তির প্রকাশ ঘটে ধনুকের টঙ্কারে ৷ মানব দেহে শক্তি সঞ্চারের জন্যই দুর্গা দেবী নিজ হাতে তীর -ধনুক বহন করেন ৷
“ঘন্টা” থাকে দেবীর বাঁ হাতে ৷ ইন্দ্র বা ইন্দ্রের বাহন হাতি ঐরাবত দেবীকে দেন ৷ যা যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে শত্রুকে দূর্বল করে ৷ “সা ঘন্টা পাতু নো দেবী পাপেভ্যো নঃ সুতাম্ ইব” ৷ অসুরদের তেজ হরণ কারী এই ঘন্টার আমরা স্মরণ নি যাতে তা আমাদের পাপ হরণ করে ৷ বাঁ হাতের নিচের দিকে থাকে অনন্ত নাগ “নাগপাশ” ৷ শেষ নাগ দেন ৷ সাপ বিশুদ্ধ চেতনার প্রতীক ৷চেতনার নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে নিয়ে যায় ৷ দেবী যখন ক্ষনে ক্ষনে রূপ পরিবর্তন কারী মহিষাসুরকে নিয়ন্ত্রণ করতে ক্লান্ত ৷ তখন নাগপাশেই সে আবদ্ধ হয় ৷ অসুরের চেতনা ফিরলে দেখে সে নাগপাশে আবদ্ধ ৷ উরুতে নিজের বাঁ পা রেখে মহিষাসুরকে বধ করেন ৷ দেবরাজ ইন্দ্রের দেওয়া “বজ্র” বা বাজ বা অশনি থাকে দেবীর বাঁ দিকের একটি হাতে ৷ যা কঠোরতা , দৃঢ়তা ও সংহতির প্রতীক। যা সমাজ জীবনে আমাদের একমাত্র কাম্য ৷ লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় ৷ “অগ্নি” অস্ত্র দেন অগ্নি দেব ৷ যা জ্ঞান ও বিদ্যার প্রতীক ৷ব্রহ্মা দেবী দুর্গাকে দেন “পদ্ম , অক্ষমালা ও কমন্ডলু “৷ হিন্দু ধর্মে “পদ্ম” বিশেষ পবিত্র ৷ব্রহ্মা দেবীকে পদ্ম দিয়ে দেখান মায়ের আর্শীবাদে আঁধারেও আলো ফুটে ওঠে ৷ জীব জগৎ সৃষ্টিকে পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হয় ৷
অসুরদেরও অন্ধকার দূর হয় ৷তাই প্রায় সব দেবদেবীর অধিষ্ঠান প্রস্ফুটিত পদ্মে ৷ একে মনে করা হয় সব শক্তির আধার ৷ দেবীর ডান হাতে থাকে অক্ষমালা ও কমন্ডলু যা পবিত্রতার প্রতীক। এছাড়াও দেবীকে আরো বহু কিছু দিয়ে দেবতারা সাজান ৷ অগ্নি দেন তেজ যা আগেই বলেছি ৷ সূর্য দেন তপ্ত কাঞ্চন রঙ ৷ চন্দ্র দেন চন্দ্র প্রভা ৷ বিশ্বকর্মা দেন অভেদ্য কবজ কুন্ডল ৷অর্থাৎ” কুঠার ও ঢাল” গিরিরাজ হিমালয় দেন বাহন সিংহ ৷ আমাদের সবার মধ্যে পশু শক্তি আছে ৷ যা আমরা নিজেদের কাজ , সাধন -ভজন ও পুরুষকারের দ্বারা কাটাতে পারি ৷দেবীর পদতলে সিংহ মানে পশুত্ব বিনাশকে বোঝায় ৷আর ধনদেব কুবের তাঁকে বহুবিধ অলঙ্কারে সাজিয়ে তোলেন ৷
Be First to Comment