—————-স্মরণঃ মাক্সিম গোর্কি—————–
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, বিশ্বসাহিত্যে উনিশ শতকে যে কয়েকজন হাতেগোনা সাহিত্যিক— বিশ্বসাহিত্যে ঝড় তোলেন, ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ম্যাক্সিম গোর্কি রুশ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, রাজনৈতিক লেখক। রাশিয়ায় জারের রাজত্বকালে, প্রথাগত রচনার বাইরে গোর্কি তাঁর লেখা— গল্প, উপন্যাস, নাটকে সমাজের নিচুতলার মানুষের অত্যাচারিত হওয়ার আলেখ্য তুলে ধরেন। জারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লেখার কারণে, জীবনে বহুবার শাসকের রোষানলে পড়তে হয় গোর্কিকে। বারবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। তিনি এক সময় দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি জার্মানি ও ফ্রান্স হয়ে পাড়ি জমান আমেরিকায়। ১৯০৭ সালে সেখানে বসেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘মা’। উপন্যাসটি বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত। ‘মা’ উপন্যাস লিখে গোর্কি উঠে আসেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ‘মা’ রুশ কথাসাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি রচিত এক কালজয়ী উপন্যাস। রুশ ভাষায় লিখিত এই উপন্যাসটি বিশ্বের প্রায় সব ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ম্যাক্সিম গোর্কি’র পৈত্রিক নাম আলেক্সেই মাক্সিমোভিচ পেশকভ। তিনি ১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ রাশিয়ার নিজনি নভোগরোদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত এই নাম মুছে দিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি নামেই উত্তরকালে তিনি বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে বিখ্যাত হন।
ছোটবেলায়ই তিনি বাবাকে হারান। বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর খ্যাতিমান হয়ে উঠার ক্ষেত্রে, তাঁর বাবা ম্যাক্সিম পেশকভের কোনো অবদান না থাকলেও— মা ভার্ভারা’র অবদানকে কোনো অংশেই খাটো করে দেখা যাবে না। মা তাঁকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করেন। কিন্তু মায়ের স্নেহ ভালোবাসা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। গোর্কির অল্প বয়সেই মা ক্ষয়রোগে মারা যান। মা’র মুত্যুর পর তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব দাদামশাইয়ের ওপর পড়ে। তিনি গোর্কির দায়িত্বভার নিতে চাইলেন না।
তারপর শুরু হয় আলেক্সেই মাক্সিমোভিচ পেশকভ ওরফে মাক্সিম গোর্কি কঠিন জীবন সংগ্রাম। প্রথমে তিনি একটি শৌখিন জুতার দোকানে কাজ শুরু করেন। তাঁকে সেখানে সারা দিন শ্রম দিতে হতো। পরে কিশোর পেশকভ কাজ নেন কয়েদি বহনের জাহাজে। তাঁর কাজ ছিল জাহাজের কর্মচারীদের বাসন ধোয়া। সেই কাজটাও তাঁর জন্য সহজ ছিল না। ভোর ছয়টা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত তাঁকে কাজ করতে হতো। কিন্তু পেটের তাগিদে এসব করা ছাড়া পেশকভের আর কোনো উপায়ও ছিল না। ভালো কাজের আশায় পেশা বদলাতে থাকেন পেশকভ। কিন্তু কোথাও তিনি শান্তি ও সুখ খুঁজে পাননি। পেশকভ কিন্তু শান্তি খুঁজে পেতেন বইয়ের পাতায়। বইপড়া তাঁর নেশা ছিল। তিনি ছিলেন বইয়ের পোকা। অভাব-অনটন, হাড়ভাঙা পরিশ্রম এত কিছুর মধ্যেও থামেনি তাঁর বইপড়া। সর্বভূকের মতো যা পেতেন তাই পড়তেন। একদিন হাতে এল মহান রুশ কবি পুশকিনের একটি কবিতার বই।
একনিষ্ঠভাবে কবিতার বইটিপড়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। তাঁর পড়া অসংখ্য বইয়ের মধ্যে রুশ কবি পুশকিনের— এই কবিতার বই তাঁকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। এক সময় তিনি এই চেতনা থেকে যোগ দেন বিপ্লবী দলে। বিপ্লবী দলে যোগ দেয়ার পর তাঁর জ্ঞান-ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হয়। এক সময় তাকে রুটির কারখানায় কাজ নিতে হয়। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে পরদিন দুপুর পর্যন্ত তাঁকে একটানা কাজ করতে হতো। দারিদ্রের কশাঘাত আর দিনের পর দিন হাড়ভাঙা শ্রমের ধকলে, মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। জীবন হয়ে পড়ে তাঁর কাছে মূল্যহীন। বেঁচে থাকা হয়ে পড়ে নিরর্থক। তিক্ত জীবনের অবসান ঘটাতে পিস্তল কিনেন গোর্কি।১৮৮৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২০ বছর। নদীর তীরে গিয়ে নিজের বুকে গুলি করেন পেশকভ। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা তাঁর জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। এক বৃদ্ধ বিপ্লবী মাঝে মাঝে রুটির কারখানায় আসতেন। সুস্থ হয়ে উঠলে গোর্কিকে নিয়ে যান তার গ্রামের বাড়িতে। কোথাও বেশিদিন থাকতে মন চায় না। এই সময়ে তিনি কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন। নাম দেন ‘পুরোনো ওকের গান’। দুজন বিপ্লবীর সঙ্গে পরিচয় ছিল। সেইজন্য পুলিশ তাকে বন্দী করে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছুদিন পর তাকে ছেড়ে দেয়। তারপর শুরু হয় তাঁর দ্বিতীয় জীবন। নব-উদ্যমে জীবন শুরু করেন পেশকভ। বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গোর্কি হাতে পায় মার্ক্সের রচনাবলি। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি, দর্শন, আরো আরো নানান বিষয়ের বই পড়তে আরম্ভ করলেন। তখনও অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। পরবর্তীতে কুলঝানি নামক একভদ্রলোক তাঁকে নিয়ে গেলেন স্থানীয় পত্রিকা অফিসে। নিজের নাম সই করার সময় ‘আলেক্সই পেশকভ’ এর পরিবর্তে লিখলেন ম্যাক্সিম গোর্কি। ম্যাক্সিম শব্দের রুশ অর্থ হলো তিক্ত। গল্পটি প্রকাশিত হল ১৮৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ‘এমিলিয়ান পিলিইয়াই’ গল্প পড়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক ভ্লাদিমির গালাক্কিওনচিভচ করলিয়েনক উৎসাহ দেবার পর ‘চেলকাশ’ গল্প যখন কাগজে বের হয়— তখন গোর্কিকে তিনি সাংবাদিকতার চাকরির প্রস্তাব দেন। সামারার একটি বড় কাগজে চাকরি।মাস গেলে ১০০ রুবল। গোর্কিও সানন্দে রাজি হন।
তিফলিস শহর থেকে প্রকাশিত ‘কাফকাজ’ (ককেশাস) দৈনিক সংবাদপত্রে ১৮৯২-এর ১২ সেপ্টেম্বর শনিবার রুশ ভাষায় একটি গল্প ছাপা হয় ‘মাকার চুদরা’। লেখকের নাম ম. গোর্কি। এরপর অনেক পত্রিকায় তার গল্প ছাপা হতে থাকে—ভোলগা সংবাদপত্র, দৈনিক সামারা, ওদেসা সংবাদ, নিঝেগরোদ পত্র ইত্যাদি। ১৯১৫ সালে গোর্কি নিজেই লিয়েতপিস (কড়চা) পত্রিকা প্রকাশ করেন। গোর্কি তাঁর ছোটবেলার ভোগান্তি, দুর্ভোগ, বাস্তবচিত্র তুলে ধরেন আত্মজৈবনিক ট্রিলজি— ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘পৃথিবীর পথে’, ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’ গ্রন্থে। তিনি তাঁর ছোটবেলার কাহিনি থেকে আরম্ভ করে পোড়খাওয়া তরুণ জীবনের কাহিনি বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে উপস্থাপন করেছেন। ১৮৯৮ সালে তাঁর লেখা প্রবন্ধ ও গল্প নিয়ে একটি ছোট সংকলন প্রকাশিত হয়। সংকলনটির নাম দেওয়া হয় ‘রেখাচিত্র ও কাহিনি’। এই বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গোর্কি খ্যাতি। মূলত প্রথম দিকে তিনি লিখতেন প্রথাগত নিয়মে। তাঁর অন্যান্য গল্পগন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ‘মানুষের জন্ম (১৮৯২)’, ‘বুড়ি ইজরেগিল (১৮৯৪), ‘চেলকাশ (১৮৯৪)’, ‘কনভালভ(১৮৯৫)’, ‘বোলেসস্নভ (১৮৯৬)‘, ‘ঝড়োপাখির গান (১৯০১)’ ইত্যাদি। তারপর এক সময় তাঁর পরিচয় হল এক বিখ্যাত তরুণ লেখক ভ্লাদিমির করোলেঙ্কার সঙ্গে। করোলেঙ্কার কথায় চেতনা ফিরে পেলেন গোর্কি। প্রথাগত চেতনার ধারাকে বাদ দিয়ে শুরু হল তাঁর নতুন পথে যাত্রা। সমাজের নিচুতলার মানুষেরা— চোর, লম্পট, ভবঘুরে, মাতাল, বেশ্যা, চাষী, মজুর, জেলে প্রকাশ পেতে থাকে তাঁর রচনায়। এই পর্বের কয়েকটি বিখ্যাত গল্প হল ‘মালভা’, ‘বুড়ো ইজরেগিল’, ‘চেলকাশ’, ‘একটি মানুষের জন্ম’। গল্পগুলিতে একদিকে যেমন ফুটে ওঠেছে নিচু তলার মানুষের প্রতি গভীর মমতা অন্যদিকে অসাধারণ বর্ণনা, কল্পনা আর তাঁর সৃজনশক্তি। তিনি উপন্যাস এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি।
১৯০০ সালে প্রকাশিত হয় গোর্কি সার্থক উপন্যাস ‘ফোমা গর্দিয়েভ’। ১৯০১ সালে বিপ্লবী ছাত্রদের হত্যার প্রতিবাদে গোর্কি রচনা করলেন ‘ঝোড়ো পাখির গান’ নামের কবিতাটি। ‘ঝোড়ো পাখির গান’ হয়ে ওঠে বিপ্লবের মন্ত্র। গোর্কি লেখার জীবনবোধ ও ক্ষুরধার রাশিয়ার জার শাসকদের বিচলিত করে তোলে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে প্রতিবাদের মুখে তাঁকে আবার ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয় সরকার। ধীরে ধীরে গোর্কি হয়ে ওঠেন লেনিন আদর্শের কর্মী। গোর্কিকে নির্বাসনে দেয় শাসকচক্র। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে পাঠানো হয় ক্রিমিয়ার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সুস্থ হয়ে নাটক লিখতে শুরু করেন গোর্কি। ১৯০২ সালে লিখলেন নাটক ‘লোয়ার ডেপথ’ (নিচুতলা)। এই নাটকের বাণী ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের সর্বত্র। তখন গোর্কির পরিচিতি রাশিয়ার সীমা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপে। গোর্কি হয়ে ওঠেন ইউরোপের শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর।
ম্যাক্সিম গোর্কি ১৯৩৬ সালের আজকের দিনে (১৮ জুন) নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
Be First to Comment