জন্মদিনে স্মরণঃ মা নি ক ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
‘’দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না আসে।’’
[ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ]
বাবলু ভট্টাচার্য : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের যে চরম সংকট দেখা দিয়েছিল, তারই প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলা কথা-সাহিত্যে আমূল পরিবর্তনের এক ধারা সূচিত হয়। যে কয়েকজন লেখকের হাতে এ বৈপ্লবিক ধারার সূচনা হয় মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রিয়ালিটি বা জীবনবাদী শিল্পী।
বাড়ির দেওয়া ভালো নাম প্রবোধকুমার এবং ডাকনাম মানিক। প্রথম গল্প ছাপতে দেন ডাকনামেই, সেই থেকে আসল নাম চাপা পড়ে যায়।
বিএসসি পরীক্ষায় দু’বার আকৃতকার্য হওয়ার পর কলেজের পড়া অসমাপ্ত রেখে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। অথচ ম্যাট্রিক এবং আইএসসি-তে ভাল ফল করেছিলেন, অঙ্কে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে।
প্রথম কিছুদিন এক পত্রিকায় সহ-সম্পাদকের চাকরি, পরে ভাইয়ের সঙ্গে প্রকাশনা ব্যবসা এবং একটি অফিসে চাকরি। শেষে চাকরি ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। তখন থেকে সাহিত্যই তাঁর জীবন ও জীবিকার একমাত্র অবলম্বন।
১৯৪৬ সালে দাঙ্গা-বিরোধী ভূমিকা এবং ১৯৫৩ সালে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। মার্কসের শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব এবং ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের শিল্পিত প্রয়োগে তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে অনন্য মর্যাদা পেয়েছে।
প্রথম দিকের লেখায় কল্লোল যুগের উত্তরাধিকার নিয়ে মানব চৈতন্যের গভীর তলদেশে বিচরণ করেছেন। পরে সাহিত্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সমাজচেতনা প্রকাশের অত্যাধিক আগ্রহে শিল্পবোধ বিসর্জন দিয়েছিলেন এ রকম একটা ধারণা কোনো কোনো মহলে চালু আছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৩৮টি উপন্যাস এবং ১৯০টি গল্প মিলিয়ে মোট গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ষাটটি। কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৫ সাল থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। তিনি যখন সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন, তখন ফ্রয়েডীয় মনোবিকারতত্ত্ব সাহিত্যিক মহলে খুব জনপ্রিয়তা পান এবং এবং পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত তার লেখনীতে বিশাল বিস্তীর্ণ নদ-নদীর পটভূমিকায় সাধারণ মানুষের কথা যেমন বস্তুনিষ্ঠ জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন, তেমনি মানুষের কর্মে পিপাসায় জীবনচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আদিমতার অন্ধকারে ফিরে গেছেন বার বার।
অদ্ভুত নিরাসক্তভাবে তিনি মানুষের জীবন ও সমস্যাকে দেখেছেন, সমাধানের চেষ্টাও করেছেন বুদ্ধি ও লেখনীতে। নর-নারীর জৈবসত্তা বিকাশের নানাদিক তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তার লেখায় জৈবসত্তা ও দৈহিক বর্ণনায় ছিলেন কিছুটা বেপরোয়া প্রকৃতির।
দৈহিকভাবে অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে যথেষ্ট বলিষ্ঠ ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বলিষ্ঠতা রক্তের উষ্ণ-স্রোত উত্তাপ টের পাওয়া যায় তার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের বর্ণনায়, পেশায়, কাজে-কর্মে।
মানিকের সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশটা একটা চমক এবং চমক ‘অতসী মামী’ রচনার ইতিহাস, চমক ‘দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), ‘জননী’ (১৯৩৫), ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬), ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬), ‘অহিংসা’ (১৯৪৮) ও চতুষ্কোণ (১৯৪৩) প্রভৃতি। পাঠকের চেতনাকে নাড়া দিতে পেরেছেন বলেই এগুলো পাঠকের কাছে আদরণীয়।
১৯৩৫ সাল থেকে লেখক মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন যা পরবর্তী কালে জটিল অবস্থায় গমন করে। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালের আজকের দিনে (১৯ মে) সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment