Press "Enter" to skip to content

মানসকন্যা ভগিনী নিবেদিতা স্বামীজির শিয়রের কাছে বসে পড়েন। নয়নে অবিরল অশ্রুধারা, কম্পিত হাতে তুলে নেন গতপ্রাণ স্বামীজির মাথাটি। এখন আর তিনি কন্যা নন, তিনি মাতা!………

Spread the love

—————স্মরণঃ স্বামী বিবেকানন্দ————-

১৮৯৮ সালে স্বামী বিবেকানন্দ শেষবারের মতো হিমালয়ে গিয়েছিলেন। শৈবতীর্থ অমরনাথে শিবের কাছে স্বামীজি ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন। গুহা থেকে বেরিয়ে প্রিয় শিষ্যা নিবেদিতাকে তিনি প্রথম সে কথা জানান। স্বামীজির মর্ত্যজীবনের এই পরম প্রার্থনাটির কথা জেনে বিস্মিত হন নিবেদিতা। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই স্বামীজির সেই প্রথম ইচ্ছাপূরণের দিনটি এল। সে দিন শুক্রবার। বেলুড় মঠে সন্ধ্যায় মন্দিরের প্রার্থনার সময় স্বামীজি তাঁর নিজের ঘরে ধ্যানাসনে বসে রাত ৯ টায় শান্তভাবে মহাসমাধি লাভ করেন। সেই অনিন্দ্যসুন্দর দিব্যকান্তি মুখমণ্ডল দেখে প্রথমে কেউ বুঝতেই পারেননি যে, এ স্বামীজির অমৃতধামযাত্রা তথা দু’বছর আগে হিমালয়তীর্থ অমরনাথধামে তুষারলিঙ্গ মহাদেবের কাছে গিয়ে তাঁর ইচ্ছামৃত্যু প্রার্থনার ‘প্র্যাক্টিক্যাল ডেমনস্ট্রেশন’। পরদিন ৫ জুলাই, শনিবার। তখন ভগিনী নিবেদিতার ঠিকানা ১৬ নম্বর বাগবাজার লেন। সকাল ৯টা নাগাদ বেলুড় মঠ থেকে একটা ছোট চিঠি পান স্বামী সারদানন্দজি স্বাক্ষরিত নিম্নলিখিত বয়ানে– ‘মাই ডিয়ার নিবেদিতা, দ্য এন্ড হ্যাজ কাম, স্বামীজি হ্যাজ স্লেপ্ট লাস্ট নাইট অ্যাট নাইন ও’ ক্লক। নেভার টু রাইজ এগেন, সারদানন্দ’। চিঠির অক্ষরগুলি যেন চোখের সামনে কাঁপছে নিবেদিতার, সঙ্গে শরীরটাও। ঘরে উপস্থিত নিবেদিতার সেবিকাও কেঁদে উঠলেন। মাত্র দু’দিন আগেই তো নিবেদিতা বেলুড় মঠে গিয়েছিলেন স্বামীজিরই নিমন্ত্রণে। স্বামীজি তাঁদের খাইয়েছিলেন পরম যত্নে এবং আহার শেষে স্বামীজি অতিথিদের হাতে জল ঢেলে দিয়েছিলেন হাত ধোওয়ার জন্য। নিবেদিতা সঙ্কুচিত হয়েছিলেন। স্বামীজি বলেছিলেন, “যিশু তো শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন।” কিন্তু সে তো শেষের দিনে। তখন নিবেদিতা ভাবতেও পারেননি, তাঁর গুরুর ক্ষেত্রেও এই কথাটা আক্ষরিক অর্থেই মিলে যাবে। নিবেদিতা আর কালবিলম্ব না করেই বেলুড় থেকে আসা পত্রবাহকের সঙ্গেই রওনা হলেন বেলুড় মঠ অভিমুখে। ইতিমধ্যে স্বামীজির প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে গিয়েছে সারা শহরে। সবাই ছুটছে সেই বেলুড়ের দিকে। বেলুড় মঠে পৌঁছেই নিবেদিতা সোজা উঠে গেলেন দোতলায় স্বামীজির ঘরের দিকে। ঘরে তখন বেশি লোকজন নেই। স্বামীজির দেহটি মেঝেতে শায়িত হলুদ রঙের ফুলমালা আচ্ছাদিত হয়ে। মানসকন্যা স্বামীজির শিয়রের কাছে বসে পড়েন। নয়নে অবিরল অশ্রুধারা, মুখে কোনও কথা নেই। আবেগ-আকুল কম্পিত হাতে তুলে নেন গতপ্রাণ স্বামীজির মাথাটি। এখন আর তিনি কন্যা নন, তিনি মাতা!

একে একে সন্ন্যাসী-ভাইরা এসে স্বামীজির দেহটি নীচে নামিয়ে আনেন। আরতি ও প্রণাম শেষে পা দু’টি অলক্তরাগে রঞ্জিত করেন ও মস্তক অবলুণ্ঠিত করে প্রণাম করেন। গুরুভাইরা শ্রীপাদপদ্মের ছাপ নেন। নিবেদিতাও অশ্রুসিক্ত নয়নে পা দুটি ধুয়ে একটি পরিস্কার রেশমি রুমালে তাঁর গুরুর পদচিহ্ন গ্রহণ করেন। সন্ন্যাসী ও সমবেত জনতার সঙ্গে নিবেদিতাও চলেন পায়ে পায়ে সেই গতপ্রাণ বিজয়ী বীরের দেহটি নিয়ে মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে। স্বামীজির শেষকৃত্য সমাপনের নির্দিষ্ট স্থানে, যে স্থান বিবেকানন্দ নিজেই চিহ্নিত করেছিলেন মহাপ্রয়াণের কিছু দিন আগে, তাঁর প্রিয় বেলগাছের কাছে অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায়। দেহটি নামানো হলে নিবেদিতা সেই গাছেরই একটু দূরে এসে বসে পড়েন। চিতাগ্নি প্রজ্বলিত করেন প্রথমে নিবেদিতা ও পরে একে একে গুরুভাই ও অন্যান্য সন্ন্যাসী-ভাইয়েরা। সারা অঙ্গ চন্দনচর্চিত মনুষ্যদেহে তাঁর শিবরূপী গুরুর ধূপধুনো-গুগগুল সুবাসিত চিতাগ্নি তথা হোমাগ্নি নিবেদিতার অনর্গল নয়নধারায় বুঝি নির্বাপিত করতে চান। সেই হৃদয় হাহাকার করা মুহূর্তে সহসা গুরুর এক অলৌকিক স্নেহস্পর্শ নিবেদিতাকে চমকিত করে।

চিতাগ্নি থেকে একখণ্ড গেরুয়া বস্ত্র হাওয়ায় উড়ে এসে নিবেদিতার কোলে গিয়ে পড়ে। পরম মমতায় ও যত্নে নিবেদিতা তা গুরুর আশীর্বাদ ভেবে মাথায় ঠেকান। সেই পবিত্র স্পর্শ যেন শোকস্তব্ধ হৃদয়ে সান্ত্বনা ও শক্তি জোগায়।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.