ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। ৩, ফেব্রুয়ারি, ২০২১। "তোদের চৈতন্য হোক..." অনেকেই আমায় প্রশ্ন করেন, "ম্যাজিক করে দেশের সমস্যাগুলোর সমাধান, মানে সত্যিকারের আসলি 'উন্নয়ন' করা যায় না ? "শুনলে হাসি পায়। মন খারাপও হয । কি অদ্ভুত রকম বাজে, নির্বোধের মতো সরল প্রশ্ন ! ফুস্ মনতোরে ইনি, হাওয়া থেকে ধন-দৌলত টাকা পয়সা বানিয়ে, বড় কাজ করতে বলছেন! আরে ভাই, ম্যাজিক হচ্ছে নাটুকে ব্যাপার! সত্যি জিনিষ নয়! আর ওদিকে সঠিকভাবে, পাক্কা প্ল্যানিং করে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে উন্নতির পথে কাজ না করলে কি সাফল্যলাভ করা যায়? যায় না । যা পাওয়া যায়, তা হলো 'ফক্কিবাজী'!
মিথ্যের 'foolঝুরি'। তাই নিয়ে যতো নাচন-কোদন ! এই কথাগুলো পড়ে অনেকেই অনেক কথা বলবেন। কেউ বলবেন "এ কি কথা! উন্নতি করতে টাকা পয়সা লাগবে না? বেশি টাকায় হবে বেশি উন্নতি ! অনেকেই আবার বলবেন, বড্ড বার বেড়েছে এই মাদারিটার। কাটমানি নিতে না করছে। তাহলে কিসের ইনটারেস্টে কে কাজ করে দেশের 'উন্নয়ন' করতে চাইবে ? বেশি প্রেম দেখাচ্ছে। দেবো পোষা-পুলিশ লেলিয়ে। সঙ্গে ফেউ থাকবে এক ঝাঁক বাধ্য মিডিয়া, পেইড নিউজের প্রেস! এক একজন এক একরকম গপ্পো বানিয়ে ছাপবে। মাদারিটার বাপ+বৌ সমেত নিজে+বেটিরা সব মিলে প্রায় ১০০ বছর ( সিনিয়র ৪০+ জুনিয়র ৫০+ মানেকা ১০=১০০) ধরে , ম্যাজিক দেখিয়ে, মানে চোখে ধূলো দিয়ে, অন্যায় ভাবে লোক ঠকিয়ে, বাড়ি-ঘর , বিশ্ব জুড়ে সুনাম, প্রতিপত্তি এসব বানিয়েছে । ম্যাজিক দেখিয়ে, টিকিট কাটিয়ে, পাবলিক মানি, ট্যাক্স দিয়েই 'অন্যায়ভাবে' করেছে। যদিও অন্যায়ের কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি, কিন্তু তবুও হুঁ হুঁ বাবা, আমরা জানিনা ? সৎ পথে কেউ বাঁচে? নিশ্চয়ই এতে ম্যাজিক আছে। নইলে আমাদের তাবেদার হচ্ছেনা কেন? চোর, ছ্যাচোড়, সবাই আমাদের কাছে আসে। ও কেন আসবে না। " অন্য দাপুটে শিল্পীদের মতো এরা গ্র্যাণ্ট, অনুদান নেয় না কেন ?সেই অনুদান না নিয়ে, না পেয়ে, নিজের বাড়ি নিজেরা বানিয়ে নিয়ে,ট্যাক্স্, জি.এস্.টি. সব দিয়ে, এতবড় দল নিয়ে মাসের পর মাস এদেশ-ওদেশে 'শো' দেখিয়ে বেড়াচ্ছে কীভাবে ? অ্যাঁ ? এই কোভিডের সময় শো না করেও খেয়ে বেঁচে আছে কি ভাবে? খুতিয়ে দেখতে হবে। আমরা ওদের দুঃখের সময় খোঁজ-খবর নিইনি বা পাশে থাকিনি বলে কি কিছু বুঝিনা ? অ্যাঁ ? সব দু-নম্বরী ব্যাপার। বিদেশে এবং অন্য প্রদেশে শিল্পীদেরকে 'দেশের গৌরব', 'জাতিয় গর্বের সম্পত্তি' বলে ভাবলেও বা রক্ষা করলেও এখানে, এদেশে কিছু লোক, নিজেরাই নিজেদেরকে, "দেশের গৌরব" আখ্যা দিয়ে নিজের প্রচা
র করেন ।
যেন বলেন,” এ্ঃ !! কি আস্পর্ধা ! লোক ঠকাবো কোথায় আমরা , একা । লোককে গ্যাস খাইয়ে, ক্যাশ হাতিয়ে, দ্যাশকে শ্যাষ করছি ! এখানে ডোণ্ট -ডিসটার্ব । সেজন্য মাদারি, সাবধান করে দিচ্ছি।। বডডো বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। সবাই
আমাদের কথায় ওঠে বসে। সূর্য্য ওঠে, হাওয়া বয়, সাগরের ঢেউ আসে যায়, জানো না? আর সবার মতো, তোমাকেও বশে রাখতে গলায় চেন বেঁধে থাকতে হবে। টাইম টু টাইম রশদ পাবে, কথা দিচ্ছি।
আমার হাসি পায়।
আরে বাবা, উন্নতি করতে রশদ লাগে নাকি? দরকার হয় স্বপ্ন আর মুরোদের। পৃথিবীতে যতো সফল ব্যক্তি আছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন, প্রথমে ভীষণ দরিদ্র।তারপর বড় হবার স্বপ্ন দেখে সৎ-ভাবে, প্রচুর সদিচ্ছা আর পরিশ্রম করে, ধীরে ধীরে বড় হয়েছেন। তাতে দেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। সেটাই হচ্ছে আসল ম্যাজিক। উন্নতি করার আসল রহস্য।
পুরোন আমলে প্রদর্শনীর জন্য ভারতবর্ষে প্রেক্ষাগৃহের চল বিশেষ ছিলো না। সীতাবেঙ্গা গুহা রঙ্গমঞ্চ ছাড়া আর কোনও রঙ্গমঞ্চের রেফারেন্স আমার কাছে নেই। মনোরঞ্জনের শিল্প প্রকাশ ঘটতো রাজসভায়, চারদিক খোলা রাজসভার আঙ্গিনায়। সভাকেন্দ্রে শিল্পীরা আসর বসাতেন। সামনে বসতেন উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর রাজা রাণী, চামর দোলানী বিশ্বস্ত যবনী(গ্রীক)-দাসী।পাশে থাকতো উজবেকিস্তানের কিছু পুরুষ দেহরক্ষী।
সবার যে এই রকম ছিল তা নয়, তবে, বিদেশীরা, অর্থাৎ পাঠান,মুঘল,ইউরোপীয়ানদের এদেশে আসবার আগের যে ভারত ছিলো, তখন মূলতঃ সংস্কৃত এবং তামিল এই দুই ভাষায় প্রভাবিত যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাতে রাজসভা ছাড়াও মন্দিরের চৌহদ্দীতে সেবাদাসী দের নৃত্য, গীত, এবং আরও কয়েকটা কলা চর্চার প্রবর্তন ছিল। মনোরঞ্জনের জন্য থিয়েটারের প্রচলন হয় অনেক পরে। গ্রিক সভ্যতার প্রভাবে। ‘যবনিকা পতন’ কথাটায় গ্রিক দেশ, মানে যবনদের দেশের থেকে আনা ভারী কাপড় দিয়ে ফ্রণ্ট ড্রপের কথা বোঝানোয় সে স্মৃতি এখনও বহন করছে।
রাজা মহারাজাদের আমলে সেরা অনুষ্ঠানই শুধু রাজসভায় আমন্ত্রিত হতো। রাজা তাকে যোগ্য পারিশ্রমিক দিতেন। ওই সেরা অনুষ্ঠান দেখবার জন্য অন্য রাজাদেরকে গর্বের সঙ্গে আমণ্ত্রণ করতেন। মাঝে মাঝে দু দেশের জাদুকরদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হতো। বাবা অমন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে পুরষ্কৃত হয়ে ছিলেন। তার স্মৃতিচিহ্ণ আমি যত্ন করে রেখেছি। এখন রাজাদের জমানা নেই। মহীশূরের মহারাজার জগন্মোহন প্যালেশ হলে এক সময় রাজসভা বসতো। সেখানে একমাত্র
সেরা শিল্পী কে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হতো। এখন সব পাল্টে গেছে। রাজাদের বসার উঁচু জায়গায় তৈরি হয়েছে স্টেজ। আর সভার অঙ্গনে হয়েছে অডিটোরিয়াম।
আমি যখন প্রথম ওখানে ইন্দ্রজাল দেখাই তখন মহারাজ আসেন মহারাণীর সঙ্গে শো দেখতে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সীটে প্রথম সারিতে বসে শো দেখেন। খুব খুশি হন। মঞ্চে উঠে আমায় মালা পড়ান। চিঠি লিখে অভিনন্দন জানান। কবিগুরুর পুরষ্কার কবিতা টার কথা মনে পড়ে গেল।
“নানা লোকে নানা পেয়েছে রতন,
আমি আনিয়াছি করিয়া যতন,
তোমার কণ্ঠে দিবার মতন,
রাজ কণ্ঠের মালা।”
Be First to Comment