স্মরণ : ম হা শ্বে তা দে বী
বাবলু ভট্টাচার্য : মহাশ্বেতা দেবী ইতিহাস থেকে, রাজনীতি থেকে যে সাহিত্য রচনা শুরু করেন, তা শোষিতের আখ্যান নয় বরং স্বদেশীয় প্রতিবাদী চরিত্রের সন্নিবেশ। তিনি প্রতিবাদী জীবন ও সাহিত্যের এক স্বতন্ত্র ঘরানার লেখিকা। সামাজিক দায়বোধ থেকেই তিনি তাঁর সেই উপেক্ষিত ইতিহাসের নায়কদের তুলতেন।
মহাশ্বেতা দেবী আজীবন সংগ্রামী চিন্তা চর্চা করেছেন এবং দেশ ও মানুষ সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত হবে সেই লক্ষ্যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন।
পারিবারিকভাবেই তিনি এক সাহিত্যবেষ্টিত পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন এবং সাহিত্যকেই জীবনে বেছে নিয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে দু’টি কবিতা উপহার দিয়েছিলেন।
১৯৩৬ সালে তিনি পড়াশোনা করতে শান্তিনিকেতনে যান। তখনই তাঁর লেখালেখির শুরু। ১৯৩৯ সালে তিনি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন, তখন খগেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত ‘রংমশাল’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর রবীন্দ্রনাথ-সম্পর্কিত রচনা ‘ছেলেবেলা’।
১৯৪৩-এ পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় মহাশ্বেতা দেবী প্রথম বর্ষে পড়াকালীন কম্যুনিস্ট পার্টির ছাত্রী সংগঠন ‘Girls’ Student Association এবং ত্রাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির মিটিংয়ে যোগ দিতেন, পার্টির মুখপত্র ‘People’s War’, ‘জনযুদ্ধ’ বিক্রী করতেন এবং সে পত্রিকার নিয়মিত পাঠকও ছিলেন।
তবে পার্টির মেম্বার না হয়ে এভাবেই কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মূলত তখন থেকেই তাঁর কর্মীসত্তার বিকাশ, যা পরবর্তীকালে তাঁর জীবনে আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট নাট্যকার এবং কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের সংসার জীবন ছিল দারিদ্র্যে পরিবেষ্টিত। এ সময় মহাশ্বেতা দেবী রঙ সাবান, রঙের গুঁড়ো ফেরি করেন, ছাত্র পড়ানো শুরু করেন।
১৯৪৮ সালে তাঁর একমাত্র পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্য়ের জন্ম হয়। তাদের সংসার জীবন পনের বছরের বেশি টেঁকেনি।
তিনি সুমিত্রা দেবী ছদ্মনামে ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকায় ফিচার এবং গল্প লেখা শুরু করেন। যদিও ১৯৪৯ সালে ইনকাম ট্যাক্সে কেরানির চাকরি পান, কিন্তু সে চাকরি তাঁর করা হয়ে ওঠে না। এরপর তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে পোস্টাল অডিটে আপার ডিভিশন ক্লার্কের চাকরি নেন। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক সন্দেহে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন।
দীর্ঘ পড়াশোনা বিরতির পর ১৯৬৩ সালে তিনি প্রাইভেটে ইংরেজিতে এম. এ পাশ করেন এবং ১৯৬৪ সালে তিনি ইংরেজি অধ্যাপনায় প্রবেশ করেন বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে। ইতোমধ্যে তাঁর প্রথম বই ‘ঝাঁসীর রানী’ (১৯৫৬) প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে তিনি লেখাকেই পেশা হিশেবে গ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন প্রান্তিক মানুষের কথাকার। তিনি অনুভব করেছিলেন লেখক হিসেবে, সমকালীন সামাজিক মানুষ হিসেবে, একজন বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের সব দায়দায়িত্ব বহনের অঙ্গীকার।
মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম বিখ্যাত ঢাকার এক সাহিত্যিক পরিবারে। তাঁর পিতা মণীষ ঘটক ছিলেন ‘কল্লোল’ সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি অধিকাংশ লেখা লিখতেন ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মানামে। মহাশ্বেতা দেবীর কাকা ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক এবং মা ধরিত্রী দেবী ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও সমাজকর্মী।
পরবর্তী কালে তিনি বিখ্যাত হন মূলত পশ্চিমবাংলার আদিবাসী এবং নারীদের ওপর তাঁর কাজের জন্য। তিনি বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে বিভিন্ন আদিবাসী এবং মেয়েদের উপর শোষণ এবং বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছেন।
তাঁর উল্লেযোগ্য গ্রন্থ : অরণ্যের অধিকার, নৈঋতে মেঘ, অগ্নিগর্ভ, গণেশ মহিমা, চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর, শালগিরার ডাকে, নীল ছবি, বন্দোবস্তী, আই সি পি ৩৭৫, হাজার চুরাশির মা, স্তনদায়িনী, ডাস্ট অন দ্য রোড, আওয়ার ননভেজ কাউ, বাসাই টুডু, রুদালী, ঊনত্রিশ নম্বর ধারার আসামী, প্রস্থানপর্ব উল্লেখযোগ্য।
মহাশ্বেতা দেবী বেশ কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গের জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে বিদ্বজ্জনদের মধ্যে তিনি প্রথম সারিতে ছিলেন।
মহাশ্বেতা দেবী ১৯৯৭ সালে র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, ২০০৬ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ছাড়াও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০০৭ সালে সার্ক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
মহাশ্বেতা দেবী ২০১৬ সালের আজকের দিনে (২৮ জুলাই) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment