Press "Enter" to skip to content

মহাদেব অসুরদের বিনাশের পর তাদের চিতাভস্ম থেকে বিজয়ের প্রতীক শাঁখের জন্ম বলে শৈবমতে বলা হয় ৷ বৌদ্ধ মতে আটটি শুভ লক্ষণ বা অষ্টমঙ্গলার অন্যতম শাঁখ….৷

Spread the love

” শঙ্খ বা শাঁখ ( Turbinella Pyrum )”!
——————————————————-
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ১৪, জানুয়ারি ২০২২। “শঙ্খম ” সংস্কৃত শব্দটি এসেছে “শম” মানে শুভ এবং “খাম” মানে জল শব্দ দুটি মিশে ৷ যা পরে হয়েছে “শঙ্খ” ৷ হিন্দু , বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে পুজোর অন্যতম উপাচার ৷ আমরা হিন্দুরা একে ভগবান বিষ্ণুর অবতার ভাবি ৷শাঁখ , বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর মন্দির স্বরূপ ৷ শ্বেত শঙ্খ ও লক্ষ্মী উভয়েরই বাস সাগরে ৷ সৃষ্টির আদিতে সাগরের ঘূর্ণাবর্তের মধ্য থেকে শাঁখ হাতে ভগবান বিষ্ণু আবির্ভূত হন ৷ বৈষ্ণব মতে শঙ্খাসুর দৈত্যের সতীসাধ্বী স্ত্রী তুলসী দেবীর ইচ্ছায় নারায়ণ তুলসীর দেহ থেকে সর্বগুণসম্পন্ন তুলসী গাছ ও তাঁর স্বামীর হাড় থেকে শাঁখ বা শাঁখা উৎপন্ন করেন ৷ হিন্দু সধবারা একসাথে সত্ত্বগুণের প্রতীক সাদা শাঁখা , রজঃগুণের প্রতীক লাল সিঁদুর ও তমো গুণের প্রতীক কালো রঙের নোয়া বা লোহা পরে ভারসাম্য বজায় রাখেন ৷ তিন গুণের অধীন হয়েই আমাদের সংসার ধর্ম পালন করতে হয় ৷ আর আধ্যাত্মিকতাতো ত্রিগুণাতীত হওয়ার প্রচেষ্টা ৷
মহাদেব অসুরদের বিনাশের পর তাদের চিতাভস্ম থেকে বিজয়ের প্রতীক শাঁখের জন্ম বলে শৈবমতে বলা হয় ৷ বৌদ্ধ মতে আটটি শুভ লক্ষণ বা অষ্টমঙ্গলার অন্যতম শাঁখ ৷ বেশীর ভাগ শাঁখ বাম মুখী বা ঘড়ির বিপরীত
দিকে খোলে ৷ তবে, সবচেয়ে সুলক্ষ্মণ যুক্ত দক্ষিণা
বর্তী শঙ্খ ৷ ব্রহ্ম বৈর্বতপুরাণ থেকে জানি সমুদ্রমন্থনের সময় উঠে এসেছিল দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ ৷ যা দুষ্প্রাপ্য এবং দামী ৷ এর মন্ত্র –
” ওঁ হ্রীং শ্রীং ক্লীং ব্লুং সুদক্ষিণাবর্ত্ত শঙ্খায় নমঃ “৷
১০৮ বার এই মন্ত্র জপ করে নিয়মমত শাঁখকে পুজো অর্চনা করলে সাধক সম্মান ও যশোলাভ করেন ৷ ইউরোপীয় ডাচ বা ওলন্দাজরাও শাঁখকে পবিত্র বস্তু মনে করে ৷শামুক জাতীয় প্রাণীর কোষাস্থি হয় ৷ যে দেহাবরণ ঐ জীবের আত্মরক্ষায় কাজ করে ৷ তেমনি এক সামুদ্রিক প্রাণী হল শঙ্খ বা শাঁখ ৷ মৃত এই প্রাণী দেব কৃপায় হয়ে ওঠে পবিত্র ৷ নারায়ণ হলেন শঙ্খ , চক্র, গদা ও পদ্মধারী ৷ শাঁখের ব্যবহার দু রকম ৷ এক বাদ্যযন্ত্র এবং দুই অঙ্গাভরণ বা অলংকার রূপে ৷ পঞ্চজন নামের এক অসুরের ইচ্ছা ছিল শ্রীভগবান কৃষ্ণের করস্পর্শ পাওয়ার ৷ তার শ্রীকৃষ্ণ তাকে বধ করার পর তার হাড় দিয়ে পাঞ্চজন্য শঙ্খ তৈরী করেন ৷ মহাভারত থেকে জানি যুধিষ্ঠিরের অনন্ত বিজয় , ভীমের পৌন্ড্র , অর্জুনের দেবদত্ত , নকুলের সুঘোষ ও সহদেবের মণিপুষ্কক নামের শাঁখের কথা ৷ যা মহাভারতের যুদ্ধ সহ নানা সময়ে ব্যবহার করেন ৷ পঞ্চজন অসুরের অন্তিম ইচ্ছামত শ্রীকৃষ্ণ জানিয়েছিলেন যে বাড়ীতে শাঁখ বাজবে সেখানে লক্ষ্মী নারায়ণ বিরাজমান রইবেন ৷ তাহলে বোঝা গেল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে এদেশে শাঁখ ও শাঁখা ব্যবহৃত হয়েছে ৷ বঙ্গোপসাগর , ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর থেকে শঙ্খ উত্তোলিত হয় ৷ তামিলনাড়ুর পুরানো রাজধানী কোরকোই ও কায়েল থেকে দু হাজারের বেশী প্রাচীন শঙ্খশিল্পের নিদর্শন মিলেছে ৷ বাংলার শঙ্খবণিক বা শাঁখারীরা দক্ষিণ ভারত থেকে শাঁখ ও শাঁখা তৈরী করতে বাংলায় এসেছিলেন বলে ঐতিহাসিকদের অনুমান ৷ অন্য বাদ্যযন্ত্র ঠাকুরের পাশে রাখা হয় না ৷ কিন্তু , দৈববস্তু মনে করা হয় বলে শাঁখ রাখা থাকে ৷ বিষ্ণুর হাতে থাকে পদ্ম শঙ্খ, সিদ্ধিদাতার হাতে গণেশ শঙ্খ , ধর্মীয় কাজে ব্যবহারের অযোগ্য গোমুখ শঙ্খ , কৌড়ি শঙ্খ , পূজায় লাগে জল শঙ্খ সহ হরেক রকম মঙ্গলশঙ্খ দেখা যায় ৷ আবার শঙ্খিনী শঙ্খ অশুভ ৷ এর খাঁজগুলো অসমভাবে বন্টিত৷ একে দিয়ে অঘোরীরা কালো যাদু করে ৷”হরি ওঁ” মন্ত্রোচারণ করে আমরা প্রথমে শাঁখের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে প্রদীপ দিয়ে আরতি করে নৈবেদ্য দিয়ে পুজোয় শাঁখ বাজাই ৷ শাঁখ দিয়ে প্রথম গহনা শাঁখা তৈরী করেছিলেন দেব কারিগর বিশ্বকর্মা ৷ দেবী দুর্গার জন্য প্রথম শাঁখা করে দিয়েছিলেন ৷ এছাড়া দেবী দুর্গার দশ হাতের একটিতে শাঁখও থাকে ৷ দেবদেবীদের সমস্ত অলংকার দুর্গার শাঁখার কাছে ম্লান হয়ে যায় ৷ বিবাহিতা হিন্দু নারীর সতীত্বের প্রতীক , সবচেয়ে মনোরম ও সেরা এবং অপরিহার্য অলংকার হয় “শাঁখা” ৷ নানারকম শাঁখা পাওয়া যায় ৷ প্রাপ্তির উপর দামের অনেক তফাৎ ৷ তিতপুটি , রামেশ্বরী , ঝাঁঝি , দোয়ানি , গড়বাকি , দুয়ানাপাটি , মতি ছালামত , আউলাকেশী ইত্যাদি শঙ্খ থেকে গহনা হয় ৷”শিবায়ণ” সহ অনেক পুরাণে আছে শিব শাঁখারীর বেশে মা দুর্গাকে শাঁখা পরিয়ে দিয়েছিলেন৷ তাই , শাঁখা হয়ে ওঠে দাম্পত্য সুখের প্রতীক ৷ স্বামী মারা গেলে নারীর শাঁখা ভেঙে দেওয়া হয়৷ এমনিতে শাঁখা ভেঙে গেলে কেউ শাঁখা ভেঙেছে বলে না ৷ বলে “বেড়ে গেছে “৷ শাঁখ – সূর্য ও চাঁদের মত পবিত্র ৷ বলা হয় সূর্য , চন্দ্র ও বরুণদেব শাঁখের নিচে অধিষ্ঠান করেন আর মাঝখানে থাকেন প্রজাপতি
ব্রহ্মা এবং বাকী অংশে গঙ্গা ও সরস্বতী ৷ সম্পদের দেবতা কুবের শঙ্খে বাস করেন ৷ তাই ,পুজো ও অনুষ্ঠানে গঙ্গা জলের অভাব পড়লে শাঁখের ভিতরে জল দিয়ে সেই জল শুভ কাজে ব্যবহার করা হয় ৷ তবে মহাদেব ও সূর্যদেবকে স্নান করাতে শঙ্খ ব্যবহার করা হয় না ৷ কারন শিব শাঁখে বিষ বা হলাহল নিয়ে সমুদ্র মন্থনের সময় পান করে নীলকন্ঠ হয়েছিলেন ৷ ভগীরথ শাঁখ বাজিয়ে গঙ্গাকে মর্ত্যে আনেন ৷ কবিগুরু “শঙ্খ” কবিতায় শাঁখকে কল্যাণ ও বরাভয়ের প্রতীক এবং সবশক্তির একীভূত আধার হিসাবে চিত্রিত করেছেন ৷
শাঁখ বাজানোর নিয়ম – তিন বার ৷ তাতে ব্রহ্মা ,
বিষ্ণু , মহেশ্বর সহ সব দেবদেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ৷ কিন্তু , চারবার বাজালে তা হয় অসুর ডাকা ৷

কারন , সমুদ্র মন্থনের সময় অসুররা এভাবে বলিকে আহ্বান করেছিলেন ৷ শাঁখ বাজিয়ে মন্দিরের দরজা খুলতে হয় ৷ দেবাচর্না ছাড়াও দৈব দুর্বিপাকে সবাইকে জানান দিতে ঘন ঘন শাঁখ বাজানো হয় ৷শাঁখ হলো “ওঁ” ধ্বনির উৎপাদক ৷ শঙ্খ থেকে উৎপন্ন তিনটি ধ্বনি হলো – চৈতন্য , ধ্যান ও আনন্দ ৷ চন্দ্রের আর্শীবাদ পুষ্ট শাঁখের ভিতর বায়ু , পৃথিবী ও নক্ষত্ররা প্রতীকী ভাবে থাকে ৷ আরতির সময় পুজোর আগে যে শাঁখ বাজানো হয় পরে অন্য শাঁখ বাজানো হয় ৷ মন্দিরের দরজা খুলতে হয় শাঁখ বাজিয়ে ৷ প্রকৃতিতে তিনরকম তরঙ্গ থাকে ৷ সত্ত্ব গুণের সত্যবাদী তরঙ্গ রাজসিক ও তামসিক তরঙ্গকে প্রতিহত করে অহংবোধ , জড়তা ও অন্ধকার দূর করে সবকিছু পবিত্র করে ৷ শঙ্খধ্বনি বাতাসের সাথে মিশে থাকা জীবাণু ধ্বংস করে বলে যর্জুবেদে বলেছে যা বিজ্ঞান মেনে নিয়েছে ৷ নিয়ম করে শাঁখ বাজালে
মস্তিষ্কের গোড়ার সুষুম্না কান্ড সতেজ করে ৷ সুনাম , যশ ও দীর্ঘায়ুর সঙ্গে পাপ ও ক্লেশ দূর করে ৷ ব্রহ্মবৈর্বত পুরাণ মতে এনে দেয় খ্যাতি , আয়ু ও সমৃদ্ধি ৷ শঙ্খ কূটরস পুষ্টিবর্ধক ও বলকারক ৷ আয়ুর্বেদে শঙ্খচূর্ণ মুখের ব্রণ ও দাগ সারাতে আজও ব্যবহৃত হয় ৷ “শঙ্খবতী” ওষুধটি বদহজম , ডিসপেপসিয়া ও পিত্ত দমনে কাজ করে ৷ শাঁখার সাদা রং সত্ত্ব গুণ স্বরূপ ৷ প্রাচীন হিন্দু বিজ্ঞানীরা বলেছেন নিয়মিত শাঁখ বাজালে হার্ট ও লাং ভালো থাকে ৷ শাঁখের অলঙ্কার মন ভালো রাখে ও চিত্তচাঞ্চল্য দূর করে ৷ শাঁখার ক্যালসিয়াম মহিলাদের রক্তহীনতা ঘাটতি মেটায় ৷ পুলস্ত সংহিতায় সম্পদ টেনে আনা ও বেঁধে রাখার উপায় দক্ষিণমুখী শঙ্খ রাখা ৷ বিশ্বামিত্র বলেছেন শাঁখ সুখ ও উন্নতি আনে৷ মহর্ষি মার্কন্ডেয় দক্ষিণ
মুখী শঙ্খকে সম্পদ ও উন্নতির উপায় বলেছেন ৷ গোরক্ষ সংহিতা বলেছে তান্ত্রিক কাজে শঙ্খ দরকার ৷
শঙ্করাচার্য বলেছেন দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ সৌভাগ্যের লক্ষ্মণ ৷ অধিকাংশ শাঁখ বাঁদিকে পেঁচানো ৷ দক্ষিণাবর্তে বাঁ থেকে ডানে গোলাকার মোড় থাকে ৷
একে ফেলে রাখতে নেই ৷
“দক্ষিণাবর্তে শঙ্খায়ং যস্য সদ্ মনি তিষ্ঠতি “৷
শাঁখ বাজিয়ে ভূমিকম্পে মানুষ জানান দেয় ৷ আগে
সব হিন্দু বাড়ীতে ভোরে ও সন্ধ্যায় শঙ্খ ধ্বনি করা হতো৷ এখন অনেক বাড়ীতে সে রেওয়াজ নেই ! আধুনিকারা শাঁখা সিঁদুর পরেন না ৷ সেটা তাঁদের অভিরুচি হলেও সাদা রঙের শাঁখা কিংবা লাল রঙের সিঁদুরের মত রূপ সজ্জা আর কিসে হয় ?
**এই তথ্য সমৃদ্ধ আপনাদের কেমন লাগলো কমেন্ট বক্সে লিখে জানাবেন।**

More from CultureMore posts in Culture »
More from InternationalMore posts in International »
More from SocialMore posts in Social »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.