শু ভ জ ন্ম দি ন ম নো জ মি ত্র
বাবলু ভট্টাচার্য : স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় নাট্যকারদের মধ্যে মনোজ মিত্র অন্যতম৷ তাঁর নাটকে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের সমাজ সমস্যা, সমাজ মনস্তত্ব, ব্যক্তির সমকালীন ও চিরকালীন সংকট নানা ভঙ্গিমায় প্রকাশ পেয়েছে৷ শুধু বিষয়বস্তুগত বৈচিত্র্য নয়, আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও তার স্বতন্ত্রতা লক্ষণীয়৷ তাঁর নাটক শুধু নাটক নয়, সাহিত্য পাঠেরও স্বাদ দেয়৷ সংলাপে যেমন রয়েছে নাট্যগুণ, তেমনি রয়েছে সাহিত্যের গুণ৷ বিশেষ ‘ইজম’ নয়, মানবিকতাবোধেই তাঁর নাটকের সেরা হাতিয়ার।
মাত্র তিরাশি পেরিয়েও ঘাটতি নেই অভিনয়ে। এখনও রাত জেগে নাটক লেখেন। আর নাটকের ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকেন তিনি।
একশোরও বেশি নাটক লিখে বা অগুন্তি নাটক ও সিনেমার পর্দায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার পরেও বলতে পারেন– “আমি অভিনেতা। মানুষের মনের কথা বলতে ভয় পাই না।”
অবশ্য তার আগে সবটাই সুখের ছিল না। ১৯৫৭ সালের ১৫ আগস্ট কলেজ পেরোনো কয়েকজন বন্ধু মিলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘সুন্দরম’ নাট্যদল। কিন্তু শিক্ষকতার কাজে যোগ দেওয়াতে বন্ধ করতে হয়েছিল তাঁর নিয়মিত অভিনয়– “কিন্তু এমনটা তো চাইনি। তাই ফের ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই নাটক নিয়েই।”
মনোজ মিত্রের নাটক সাহিত্য পাঠের স্বাদ দেয়। তাঁর সংলাপে যেমন বহুমাত্রিকতা, যেমন নাট্যগুণ তেমনি সাহিত্যের গুণ। রসবোধ অসামান্য। কাহিনির গভীরতা, নাট্য কাহিনিতে জীবনের অতল তল ছুঁয়ে যাওয়া– এসব আমাদের নাট্য সাহিত্যকে দিয়েছে এক বিরল মাত্রা।
একাঙ্ক নাটকগুলি তো এক এক বিন্দু সোনার বিন্দু। অসামান্য ছোটগল্পের স্বাদ ’টাপুর টুপুর’, ‘প্রভাত ফিরে এসো’ ইত্যাদি নাটকে। মনোজ মিত্রের নাটকে সাহিত্যের সেই আস্বাদ পাওয়া যায়। ‘অশ্বত্থামা’ নাটক পাঠ একটি কাব্য পাঠের অভিজ্ঞতা দেয়। তেমন অভিনয় না-হয়েও এই নাটক উচ্চারিত হয় এর সাহিত্যগুণে।
তিনি সরাসরি রাজনীতি করেননি কোনোদিন। ক্ষমতার কাছে মাথা নামিয়ে দাঁড়াননি, ক্ষমতার বিপক্ষেই কথা বলেছেন নাটকে। তা রূপকাশ্রয়ী হয়ে এসেছে সব নাটকেই। ‘নরক গুলজার’– এর সেই গান এখনো সত্য। ক্ষমতার বিপক্ষে সব সময়ই সতত।
তপন সিংহই তাঁকে সিনেমায় নিয়ে আসেন ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবিতে। তারপর তপন সিংহর অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। ‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘হুইল চেয়ার’, ‘বৈদূর্য রহস্য’ ইত্যাদি। সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’, ‘গণশত্রু’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। আরো আছে। গবেষকরা বলবেন।
তাঁর গদ্য ভাষা অনুপম। যদি ‘গল্পনা’ এবং ‘ভাসিয়ে দিয়েছি কপোতাক্ষ জলে’ এই দুটি বই পাঠক পড়েন, টের পাবেন কী অনিন্দ্য সুন্দর গদ্য শৈলীতে তা লেখা। আর জীবনের কত গভীরে তিনি যেতে পারেন।
দেশভাগ নিয়ে তাঁর একটি নাটক আছে, ‘যাদুবংশ’। সাহিত্যগুণে ভরপুর সেই নাটক স্মরণ করিয়ে দেয় বাঙালির জীবনের ভয়ানক সেই ট্রাজেডির কথা। আর এখন সংবাদ প্রতিদিন রোববার পত্রিকায় যে ধারাবাহিক লিখছেন নাট্য দর্শন নিয়ে, তা কত গভীর তা নাটকের মানুষজন কেন আমাদের মতো অনাটকীয় মানুষও আগ্রহ ভরে পাঠ করেন।
এখনও তিনি থিয়েটারের ভিন্ন সূত্র, ভিন্ন সত্তা। ‘মেষ ও রাক্ষস’, ‘নৈশভোজ’, ‘রাজদর্শন’, ‘দম্পতি’, ‘কিনু কাহারের থেটার’, ‘দর্পণে শরৎশশী’, ‘মুন্নি ও সাত চৌকিদার’-এর মতো বহু নাট্যের আগল ছেড়ে ভিন্ন মানবিকতার রচনায় মনোজ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠেন ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’, ‘গল্প হেকিম সাহেব’, ‘শোভাযাত্রা’, ‘দেবী সর্পমস্তা’, ‘রঙের হাট’ নাটকে।
বিতর্ক হবে জেনেও তিনি মহাভারতের বিভিন্ন আখ্যানকে মেলে ধরেছিলেন বর্তমানের পাদপ্রদীপে। মহাবলীর মহাপরাজয়কে ঘিরে মনোজ মিত্র প্রায় তিন যুগ আগে লিখেছিলেন ‘অশ্বত্থামা’। সেই সংকটই যেন নতুন চেহারা নেয় মনোজের মহাভারত-ঘেরা আপাত বর্তমান ‘যা নেই ভারতে’ নাটকে।
অনেকেই বলেন মনোজ মিত্র ব্যতিক্রম ব্যক্তিত্ব, যিনি নাটক নিয়ে নিজের মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সত্যিই কি তাই?
মনোজের কথায়– ‘‘থিয়েটার তো নৃত্য-গীত-ভাস্কর্য-চিত্রকলা থেকে কত সূত্র নিয়েছে। নিয়েছে এবং আত্মসাৎ করেছে। এটা করতে পারে বলেই থিয়েটারের ভাষা কখনও পুরোনো হয় না। থিয়েটার কালে কালে বিবর্তিত হয়, নতুন চেহারায় দেখা যায়। তেমনই পরিবর্তন ঘটে আমার নাটকেও।”
১৯৮৫-তে নাটক রচনার জন্যে জাতীয় স্তরে সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়াটিক সোসাইটি, ফিল্মফেয়ার, দীনবন্ধু পুরস্কার, কলাকার পুরস্কার এবং পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি সহ ২০১১ সালে বাংলাদেশ থিয়েটার দল প্রদত্ত মুনীর চৌধুরী পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি।
মনোজ মিত্র ১৯৩৮ সালের আজকের দিনে (২২ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার ধূলিহর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment