Press "Enter" to skip to content

মধুকবির জীবনটা ছিল ব্যর্থতায় ভরা। বেদনাঘন…।

Spread the love

রেখো মা দাসেরে মনে

বাবলু ভট্টাচার্য : সাগরদাঁড়ি। যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলায় অবস্থিত একটি গ্রাম।

এই সাগরদাঁড়িতেই ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি (১২৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মাঘ) ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন জননী জাহ্নবীর সন্তান দত্তকুলোদ্ভ কবি মধুসূদন।

সাগরদাঁড়ি প্রবেশ পথেই মধুসূদন একাডেমী, তারপর আমছায়ায় ঢাকা দত্তবাড়ির প্রাঙ্গণ। সামনে মধুসূদনের আবক্ষ মূর্তি। সংগ্রহশালা। সেখানে মধুসূদন দত্তের বংশতালিকা। হাতে লিখে, এঁকে চমৎকারভাবে মধু কবির জীবন বর্ণনা করা আছে দেয়ালে। মূল গৃহটিতে মস্ত চণ্ডীমণ্ডপ― ঘরে রাখা আছে সে আমলের পালঙ্ক, সিন্ধুক― সবই কাঠের, অপরূপ কারুকার্যমণ্ডিত।

যেখানে জন্মে ছিলেন কবি, সেই আঁতুড় ঘরের জায়গাটিও সযত্নে রক্ষিত। ঘুরে ঘুরে দেখলাম স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতায়। তারা মধু কবির গ্রামের মানুষ, কবির মানস ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ।

কপোতাক্ষ তীরে বাঁধানো ঘাট, উদ্যান― সব রয়েছে গভীর নৈঃশব্দ্যে ডুবে। নদী বেশি প্রশস্ত নয়, কিন্তু স্রোত আছে। নরম পলিতে ঢাকা তীর। ওপারে নির্জন মাঠ পড়ে আছে পড়ন্ত বেলার রোদে আলস্যমণ্ডিত হয়ে।

মাঠ প্রান্তর, হালকা বনাঞ্চল, অচেনা পাখির দল, মাঝে মাঝে ঘুঘু পাখির ডাক― কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না।
তীর ধরে সামনে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে মধু কবির চোখের জলে উৎকীর্ণ সেই আশ্চর্য চতুর্দশপদী― সাগর পারে গভীর রাত্রিতে কপোতাক্ষর মায়া মন্ত্রধনি শুনতে পেতেন কবি :
‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে
… বহুদেশে দেখিয়াছি বহু নদদলে।
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?’

মধুকবির জীবনটা ছিল ব্যর্থতায় ভরা। বেদনাঘন। কারণ তিনি প্রচলিত জীবনচর্চা― যা কিনা কবির আত্মাকে শৃঙ্খলিত করে, মানব জীবনকে শৃঙ্খলিত করে― তিনি সেই জীবনের বিপক্ষেই যেতে চেয়েছেন। ভাঙতে চেয়েছেন সামাজিক নিগড়গুলি। তার সঙ্গে নিজের জীবনকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সেই কারণেই ‘মেঘনাদ’ হয়ে উঠেছে তাঁর কাব্যের প্রধান চরিত্র। কবির যে ট্রাজিক জীবন তার ছায়া যেন পড়েছে এই কাব্যের ভিতরে।

মধুসূদন আমাদের পিতৃপুরুষ। তিনি আমাদের ভাষাকে সৌন্দর্যময় করেছেন। ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগিয়েছেন। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য পাঠ করতে করতে মধু কবির জীবন ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

সাগরদাঁড়ির কপোতাক্ষ তীরে বসে গ্রামের মানুষজনের মুখে শুনতে থাকি ‘বিদায় ঘাট’ এর কাহিনি।

বিলেত যাবার আগে নাকি মাইকেল মধুসূদন এই স্থানে তাবু ফেলে অপেক্ষা করছিলেন মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার কারণে বাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে ছিল― বাবা রাজনারায়ণ দত্ত, তাঁর পুত্রকে ত্যাজ্য করেছিলেন। বিলেত যাওয়ার আগে মধুকবি তাঁর তাবু ফেলে আছেন কপোতাক্ষ তীরে, মা জাহ্নবী দেবীর সঙ্গে দেখা করে বিদায় নেবেন বলে― এ হলো সাগরদাঁড়ির মানুষের কল্পনা।

মধু কবির মাদ্রাজ বসবাস কালেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। ১৮৪৮ থেকে সাত বছর তিনি মাদ্রাজে বসবাস করেছিলেন। এই বসবাসের তিন বছরের মাথায় ১৮৫১ সালে জাহ্নবী দেবী মারা যান। তিনি ১৮৬২ সালের ৯ জুন মাসে বিলেত যাত্রা করেন ক্যান্ডিয়া জাহাজে চেপে। তখন মা বেঁচে নেই। এমন হতে পারে মাদ্রাজ যাওয়ার আগে তিনি এসেছিলেন মায়ের কাছে― মাতৃমুখ দর্শনে।

কিন্তু নিষিদ্ধ পিতৃগৃহ। অপেক্ষা করছেন কপোতাক্ষ তীরে। কি বিষাদময় কণ্ঠে এই কাহিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন সাগরদাঁড়ির আর এক বৃদ্ধ আলী বক্স। বলতে বলতে তার মুখও থমথম করছিল। তিনি বলছিলেন মায়ের কষ্টের কথা। বাবার কষ্টের কথা। পুত্রকে ত্যাগ করে কি রাজনারায়ণ দত্ত সুখে ছিলেন? মধুকবিও কি বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আনন্দে ছিলেন?

খিস্টান ধর্ম গ্রহণ করায় বাবা রাজনারায়ণ দত্তর কাছ থেকে আসা পড়ার খরচা বন্ধ হয়ে যায়। চাকরির চেষ্টা ব্যর্থ হয়― রাজনারায়ণ বিরূপ হয়েছেন দেখে অন্যরাও ধীরে ধীরে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেয়। ধারদেনা বন্ধ― বিপর্যস্ত মধুকবি মাথা নামিয়ে কলকাতা ছেড়ে মাদ্রাজ যাত্রা করেন।

হয়ত মাদ্রাজ যাওয়ার আগে তিনি মা জাহ্নবী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। হতে পারে, আবার নাও পারে। কপোতাক্ষ তীরের মানুষ যখন এই কাহিনি মনে রেখেছেন, এর পিছনে সত্যতা নিশ্চয় কিছু আছে। সেই সত্য বাস্তবের হতে পারে, কল্পনারও হতে পারে।

কপোতাক্ষ তীরের মানুষ তাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানকে এভাবেও মনে রেখেছে। কবির জীবনের নানা বিপর্যয়, অপমান, ব্যর্থতায় তারা এখনো, এতো বছর বাদেও বেদনাবিদ্ধ হন। আর কবি তো শুধু নিজের বেদনার কথা লেখেননি, তাঁর বেদনা অন্যের বেদনা, বিষাদ হয়ে ওঠে বলেই তো তিনি কবি― মহৎ কবি।

রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর চিরাচরিত সংস্কার, সামাজিক মূল্যবোধ, তথাকথিত নৈতিকতাকে ভেঙে প্রতিভাবান সন্তানের পাশে দাঁড়াতে পারেন নি। সংস্কার বাঁধা দিয়েছে। সমাজ বাঁধা দিয়েছে। তিনি তাঁর পুত্রের প্রতিভাকে উপলব্ধি করতেও পারেননি। কিন্তু ত্যাজ্য করার পর বিপর্যস্ত পুত্র সমস্ত ব্যর্থতার দায় নিয়ে যখন মাদ্রাজ যাত্রা করেন, রাজ নারায়ণের বুক কি হাহাকার করে ওঠেনি? আর মা…? নাড়িছেঁড়া ধন!

রাজ নারায়ণ এবং জাহ্নবী দেবী পুত্র হারা হয়েছিলেন। পুত্র জীবিত অথচ তাঁরা প্রতিভাবান পুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁদের হাহাকার কি ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে ছায়া ফেলেনি?

‘মেঘনাদ বধ’ পড়তে পড়তে মনে হয় এই সব বিষাদ, হাহাকার, ব্যর্থতা, অপমান― মধুকবিকে অমন বিরলতম কাব্য রচনায় নিবিষ্ট করেছিল―

‘হায়রে কে কবে মোরে, ফিরিব কেমনে
শূন্য লঙ্কাধামে আর? কি সান্ত্বনা চলে
সান্ত্বনিব মায়ে তব, কে কবে আমারে?’

এ কথা মধু কবির। পিতা রাজনারায়ণ দত্তেরও।

More from BooksMore posts in Books »
More from CultureMore posts in Culture »
More from EducationMore posts in Education »
More from InternationalMore posts in International »
More from Writer/ LiteratureMore posts in Writer/ Literature »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.