জন্মদিনে স্মরণঃ মকবুল ফিদা হুসেন
বাবলু ভট্টাচার্য : নিজস্ব মহিমায় ভাস্বর শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন সফল হয়েছিলেন স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব একটি জীবনধারা গড়ে তুলতে। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত লম্বা তুলি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, যেমনটা ফরাসী শিল্পী মাতিস তার লম্বা লাঠির ডগা দিয়ে, শিল্প জগতে রাজত্ব করতেন। বা স্প্যানিশ পরাবাস্তব শিল্পের ক্ষ্যাপা রাজা শিল্পী সালভাদর দালিও তার যাদুর কাঠির মতো লম্বা তুলি নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সারা বিশ্বময়। মকবুল ফিদা হুসেন এমন শিল্পী যিনি শুধুমাত্র নিজের কাজের মাধ্যমেই পরিচিত হননি সারা বিশ্বে, তার সমগ্র জীবন যেন বহন করে আছে তার অসীম সাহসিকতার ইতিহাস। যিনি পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছেন সেই যাত্রা, কোনো শিল্পী মাত্রেরই যা কাম্য; একজন চিরায়িত প্রেমিকের স্বরূপ, এক মাতৃহারা শিশু, সুতীব্র আবেগময় দেশপ্রেমিক। শুধুই একজন শিল্পী নন তিনি একজন যোদ্ধাও বটে ! ফিদা হুসেনের শিল্পী হয়ে ওঠার গল্পের শুরুটা সবার জানা হয়ে গেছে ইতমধ্যে। ভাগ্যের অন্বেষনে এক কিশোর বোম্বে শহরে খালি পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন। অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সিনেমার পোস্টার ও ব্যানার এঁকে শুরু তার শিল্পী জীবনের যাত্রা। সেই সিনেমাতেই এসে যেন পূর্ণতা পেল শেষে তার তীর্থ যাত্রা যেন।
১৯৬৭ সালেই তিনি বানালেন প্রথম চলচ্চিত্র ‘থ্রু দ্য আইস অফ এ পেইন্টার’ এবং প্রথম ছবিতেই জিতে নিলেন বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কার। এরপর ‘গজগামিনী’— মাধুরী দীক্ষিতকে পেলাম প্রধান চরিত্রে। সেই শাশ্বত প্রেমিকার চরিত্র, যাকে দেখে কালিদাস রচনা করেছিলেন শকুন্তলা— আর যাকে দেখেই ভিঞ্চি আঁকলেন মোনালিসা। সেই চিরন্তন ভারতীয় নারীর দেখা মেলে কখনো মাতৃরূপে, কখনো প্রেমিকারূপে আবার কখনো বিদ্রোহীরূপে। সময়ের খেলা থামে না, বয়ে যায় সে, প্রেমিক মন খুঁজে বেড়ায় যুগ-যুগান্তরে সেই প্রেমিকার মন, সেই মাতৃরূপী প্রেমিকার ভালোবাসা। একাধারে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চিত্রশিল্পী, ফটোগ্রাফার, চলচ্চিত্র পরিচালক ফিদা হুসেন প্রতিভা নিয়েই জন্ম নিয়েছিলেন। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই স্বশিক্ষিত ফিদা হুসেন শুধুমাত্র নিজের দেশেই নয় বরং সারা বিশ্বে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন। তিনি আবারো প্রমাণ করলেন প্রতিভা সর্বদাই জন্মগ্রহণ করে, প্রতিভা প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠে না। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গখ যেমন ছিলেন স্বশিক্ষিত শিল্পী। বাংলাদেশের শিল্পী এস, এম সুলতান এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের আরেকটি অসাধারণ ক্ষমতা ছিল, তিনি জানতেন কিভাবে তার শিল্পকর্মকে বাজারজাত করতে হয়। এবং এই কষ্টসাধ্য কাজটি তিনি নিজেই করতেন। পৃথিবীর বহু নামিদামী অকশন হাউসগুলোতে শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের শিল্পকর্ম বিক্রি হয় আকাশ ছোঁয়া দামে। শিল্পকর্মের মূল্য অনেক বাড়িয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, শিল্পকর্মের অনন্যতাই এর বিক্রির মূল নিয়ামক, দাম নয়।
শিল্পী ফিদাকে অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে জীবনে এগোতে হয়েছে। এমনকি স্বদেশও ছাড়তে হয় এক সময়। সেই ভাবেই ফিদা হুসেন ছিটকে পড়েন নিজ দেশ থেকে ইংল্যান্ডের মাটিতে।আধুনিক শিল্পের বলয় লন্ডন-নিউইয়র্ক-প্যারিস। লন্ডন পৃথিবীর সুন্দরতম প্রাচীন শহরের একটা। সেই বলয়ে যে কোন শিল্পীই পাবেন স্বছন্দ আশ্রয়। মৃত্যু হলেও ক্ষতি নেই এই শহরের বুকে— এই শহর যুগ যুগ ধরে এমন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মৃত্যুর সাক্ষী। শেষ পর্যন্ত নিজের বুকেও ঠাই দিয়েছে তাদের। কিন্তু নিজের মাতৃভুমি থেকে বহুদুরে পর-শহরে মৃত্যুবরণ করা কারোই কাম্য নয়। ‘এশিয়ার পিকাসো’ নামে খ্যাত ফিদা হুসেন এমন একজন শিল্পী, যিনি নিজ নামে, নিজ কর্মে ও নিজস্ব শিল্পকলা কৌশলের মাধ্যমেই পরিচিত ও খ্যাত। এমন ভাবে খুব কম শিল্পী সফল হতে জানেন। যিনি জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি একই ধারায় কাজ করে গেছেন। ৯৫ বছর বয়সেও তার তুলি কাঁপেনি একফোটাও বয়সের ভারে।
এই মহান শিল্পী ২০১১ সালের ৯ জুন লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।
চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন ১৯১৫ সালের আজকের দিনে (১৭ সেপ্টেম্বর) বোম্বের প্রেসিডেন্সির পন্ধরপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment