জন্মদিনে স্মরণঃ ভূ পে ন হা জা রি কা
বাবলু ভট্টাচার্য : ‘মানুষ মানুষের জন্য’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’, ‘হে দোলা হে দোলা’, ‘মেঘ থম থম করে’, ‘বিস্তীর্ণ দুপারের’, ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘আমি এক যাযাবর’- এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের জন্য বাংলা ভাষাভাষীর মানুষের কাছে ভূপেন হাজারিকা এক আবেগের নাম।
বাংলা, অসমীয়া, হিন্দিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাঁর এক একটি গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে। কিংবদন্তীতূল্য ভূপেন হাজারিকা নামটি প্রোথিত হয়েছে মানুষের হৃদয়ে।
পিতা নীলকান্ত হাজারিকা ছিলেন একজন শিক্ষক এবং মা সুগৃহিণী। পিতার সরকারি চাকরি হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় বদলী হওয়ায় তাঁকে বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে।
১৯৪০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তেজপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। গৌহাটির কটন কলেজ থেকে ১৯৪২ সালে ইন্টারমিডিয়েট আর্টস, কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে বিএ এবং ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন ভূপেন হাজারিকা।

নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
ছোটবেলা থেকে আসামের লোকজ গানের সাথে পরিচিত ভূপেন হাজারিকা ১০ বছর বয়স থেকেই গান লিখে সুর দিতেন। ১২ বছর বয়সে অসমীয়া ছবি ‘ইন্দুমালতী’তে গান করেন ভূপেন। গানের পাশাপাশি শিশু শিল্পী হিসেব যুক্ত হন অসমের চলচ্চিত্রে। পরবর্তীতে হয়ে উঠেন প্রথম সারির পরিচালক।
ভূপেন হাজারিকার গান বাণী ও বিষয়বৈচিত্র্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বহুমুখী। তিনি আজীবন মানবতাবাদী, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে মানবপ্রেমই তাঁর গানের মূলকথা।
তাঁর গানের মধ্যে মানবিকতা, দেশপ্রেম ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বহিঃপ্রকাশ চিরায়ত। বিশেষ করে ‘মানুষ মানুষের জন্য’, ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি, ছুটে ছুটে আয়’ ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘শরৎ বাবু, খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে’, ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল’ গানগুলো মানুষের মধ্যে জাত-পাতে, বর্ণবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠার ডাক দেয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এই অঞ্চলের মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের সহযোগিতার জন্য সরাসরি রণাঙ্গনের যোদ্ধা এবং বাংলাদেশের আপামর জনগণের জন্য তাঁর ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘দোলা হে দোলা’, ‘বিস্তীর্ণ দু-পারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার’- গানগুলো ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা তো বটেই, পরবর্তীকালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও মানবিক সংকটে যুবক, তরুণদের নিত্যদিনের খোরাক ছিল এই গানগুলো।
সারাজীবন অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন ভূপেন হাজারিকা। ১৯৭৫ সালে ২৩তম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক চলচ্চিত্র ‘চামেলী মেমসাহেব’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭৭ সালে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার পান ১৯৯২ সালে। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ১৯৯৩ সালে জাপানে এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘রুদালী’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার অর্জন করেন।
তিনি ২০০১ সালে ‘পদ্মভূষণ’ ও ২০০৯ সালে ‘অসমরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন। ২০১৯ সালে মরনোত্তর ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন।
২০১১ সালের ৫ নভেম্বর এই ভুবনের মায়া ছেড়ে অন্যলোকে পাড়ি দেন ভূপেন হাজারিকা।
ভূপেন হাজারিকা ১৯২৬ সালের আজকের দিনে (৮ সেপ্টেম্বর) ভারতের আসাম প্রদেশের সদিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment