Press "Enter" to skip to content

ভারতীয় শিশু-কিশোর সাহিত্যিক লীলা মজুমদার। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে বিশ্বভারতীতে যোগ দেন। তবে বিশ্বভারতী বা অধ্যাপনা, কোনটিই তাঁর মনকে বেশিদিন সেই শান্তি দিতে পারল না…….।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ লীলা মজুমদার

বাবলু ভট্টাচার্য : শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে ইংরেজ বান্ধবীদের সঙ্গে ক্লাস করা, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে দিদির সঙ্গে স্কুল থেকে ফেরা, বর্ষা থেকে শীতে পাল্টাতে থাকা শিলং-এর আশ্চর্য রূপ, বাড়িতে কাজ করতে আসা খাসিয়া মেয়েদের মুখ থেকে সুযোগ পেলেই আজগুবি সব গল্প শোনা, আর এসবের বাইরে একা একা ঘুরে বেড়িয়ে প্রকৃতির ছোটখাটো মজা আর ভাললাগা কুঁড়িয়ে বেড়ানো— এই ছিল ছোট্ট লীলার আট বছরের রোজনামচা। আর তখন থেকেই শুরু তাঁর গল্প লেখার।

ভারতীয় শিশু-কিশোর সাহিত্যিক লীলা মজুমদার। তাঁর বাবা প্রমদারঞ্জন রায় ও মা সুরমাদেবী। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন প্রমদারঞ্জনের ভাই এবং লীলার জ্যাঠামশাই। সেইসূত্রে লীলা হলেন সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসি।

ছোটবেলা থেকেই গল্পের ভূত জেঁকে বসেছিল লীলার মাঝে। চারপাশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আট বছর বয়স থেকেই তাঁর মাথায় বাঁধতে শুরু করল মজার মজার সব গল্প। সেইসব গল্প ভাইবোনদের শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন তিনি।

ওই ছোট বয়সেই সম্ভবত তিনি টের পেয়েছিলেন, তাঁর সারা জীবনের কাজ হতে চলেছে এই লেখালিখি। তবে ছোট থেকে যে ভাষায় তিনি গড়গড় করে কথা বলতেন সে ইংরেজি ভাষাকে দূরে ঠেলে লেখার জন্য পুঁজি করেছিলেন বাংলা ভাষাকেই।

ছোট্টবেলাতেই শিলং-এর একটি বিকেলবেলা তাঁর মনে দাগ কেটেছিল। আর সেই বিকেলে যে সম্পর্কের সূত্রপাত হয়, তার চিহ্ন তিনি বহন করেছিলেন আমৃত্যু। তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি সপরিবার শিলং বেড়াতে গিয়েছিলেন যখন, বাবার হাত ধরে ছোট্ট লীলাও গিয়েছিল কবিকে দেখবে বলে। সেই তাঁর রবীন্দ্র-সংসর্গের শুরু। পরবর্তীতে খোদ কবিই তাঁকে ডেকে নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে।

শান্তিনিকেতনের কাজে মেতে থাকা, পরে মন-না-লাগায় সে-কাজ ছেড়ে চলে আসা, ফের শান্তিনিকেতনেই পাকাপাকি থাকার জন্য বসতবাটি তৈরি করা… মোট কথা, রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতনের তৎকালীন নির্ঝঞ্ঝাট প্রাকৃতিক আশ্রয়ের ছায়া তাঁকে বার বার টেনেছিল।

একদিন ‘সন্দেশ’-এর প্রথম সংখ্যা হাতে করে ভিতরমহলে এলেন কাকা উপেন্দ্রকিশোর। অমন সুন্দর পত্রিকা দেখে লেখার লোভ খুবই হয়েছিল তাঁর, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেন না। শেষমেশ লেখা হল সন্দেশ-এ। বড়দা সুকুমারের নির্দেশে একখানা ছোট গল্প লিখে দিলেন, ছাপাও হল। নাম দিয়েছিলেন ‘লক্ষ্মীছাড়া’, বড়দা বদলে রাখলেন ‘লক্ষ্মী ছেলে’।

সন্দেশে লেখা বের হওয়ার পরপরই বিভিন্ন পত্রিকা থেকে ছোটদের জন্য গল্প লিখে দেওয়ার আর্জি আসতে লাগল লীলার কাছে। কিন্তু জীবন বরাবরই লীলাকে স্থিতি থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। উপেন্দ্রকিশোর গত হওয়ার পর সুকুমারের হাত ধরেই দিব্যি এগোচ্ছিল সন্দেশ, সেই তরুণ সুদক্ষ লেখক-সম্পাদকও মারা গেলেন অকালে।

যে-মানুষটির উপস্থিতি রীতিমতো উপভোগ করতেন তিনি ছোটবেলায়, যে-মানুষটির রসবোধ চারিয়ে নিতেন নিজের মধ্যে, সেই মানুষটির সঙ্গে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল। মানুষটি স্বয়ং তাঁর পিতৃদেব প্রমদারঞ্জন রায়। বাবার অমতে ডাক্তার সুধীন কুমার মজুমদারকে বিয়ে করেন লীলা। আর সেইসঙ্গে বন্ধ হল বাবার মনে যাতায়াত করার রাস্তা। তখন থেকে মৃত্যু অবধি লীলা মজুমদারের দিকে ফিরে তাকাননি তাঁর বাবা।

রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে বিশ্বভারতীতে যোগ দেন লীলা। তবে বিশ্বভারতী বা অধ্যাপনা, কোনটিই তাঁর মনকে বেশিদিন সেই শান্তি দিতে পারল না, যার খোঁজে এতগুলো বছর হেঁটেছেন তিনি। ১৯৬১ থেকে খোদ সত্যজিৎ রায়ের উদ্যোগে ফের বেরোতে লাগল ‘সন্দেশ’, তাঁরই আর্জিতে তাঁর আদরের ‘লিলুপিসি’ সম্পাদনায় হাতে হাত মেলালেন।

শেষ জীবনটা কলকাতাতেই কেটেছিল লীলা মজুমদারের। একেবারে শেষ দিকে স্মৃতি প্রতারণা করেছিল ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে আপামর বাঙালির স্মৃতিতে শতায়ু লীলার চিরকালীন আসনটি পাতা হয়ে গিয়েছে।

লীলা মজুমদার ১৯০৮ সালের আজকের দিনে (২৬ ফেব্রুযারি) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.