সঙ্গীতা চৌধুরী : কলকাতা, ১৯ অক্টোবর ২০২১। দেখতে দেখতে অতিমারির দ্বিতীয় বর্ষের পুজো অতিক্রান্ত হয়েছে । পুজোর রেশ এখনো আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে । তবে এবারের পুজোয় কোভিড বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে সাধারণ মানুষ যে ভাবে আনন্দে মেতে উঠেছিলেন তাতে চিকিৎসক মহল ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গভীর চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছে । তাদের আশঙ্কা যে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে আর দেরি নেই । এই পুজোর আনন্দে মেতে ওঠার মধ্যে যে সবাই ছিলেন তা কিন্তু নয় । বেশ কিছু সচেতন মানুষ কিন্তু এই ভিড়ে সামিল হন নি । তারা বাড়িতে বসেই টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিমা দর্শন করেছেন । যদিও বা বেড়িয়েছেন তারা ভিড় থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন । তবে এক শ্রেণীর দর্শক কিন্তু গতবারের মতো এবারও নিজেদের গৃহবন্দি রেখেছেন । তারা হলেন পরিবারের বৃদ্ধ – বৃদ্ধারা। বিগত দুবছর ধরে তারা পুজোর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চরম উৎকন্ঠার মধ্যে তাদের দিন কাটছে।
দীর্ঘদিনের অভ্যেসের বাইরে গিয়ে এক অব্যক্ত বেদনা বুকে চেপে পুজোর সময়টা তারা বাড়িতেই কাটিয়েছেন। তবে তার মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমও ছিল, যাদের দুটো ভ্যাকসিনই হয়ে গিয়ে ছিল একমাত্র তারাই সাহসে ভর করে প্রতিমা দর্শনে বেড়িয়ে পড়েছিলেন । তাই পুজোর পর এই রকম কিছু বয়স্ক – বয়স্কার মনের অন্দরে উঁকি দিয়ে জানা গেল তাদের মনের কথা ।
ভবানী পুর নিবাসী অনিল পোদ্দার জানালেন, ” আমরা ছোটবেলায় পায়ে হেঁটে ঠাকুর দেখতাম, বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো কে কতগুলো ঠাকুর দেখেছি তা নিয়ে । সে সব দিন এখন সুখ স্মৃতি । দু বছর আগেও পুজোর সময় একটা আলাদা উত্তেজনা ছিল, কয়েকটি পুজো কমিটির সঙ্গে জড়িত ছিলাম । তাই কিছু দায়িত্ব সামলেছি। কিন্তু গত দু বছরে চিত্রটাই পুরো পাল্টে গেছে। অল্প বয়সীরা সংক্রমণের ভয়ে আমাদের ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে । এমনকি আগে যেমন গাড়ি করে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতাম এখন সেটাও বন্ধ । সব সময়ই মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করে । তাই দূর থেকেই পাড়ার প্রতিমা দর্শন করেছি। তবে টেলিভিশনের পর্দায় বড় বড় পুজো কমিটির প্রতিমা দর্শন করেই এবার সন্তুষ্ট থেকেছি ।
আগে পুজোর অনেক আগে থাকতেই কয়েক সেট নতুন পোশাক রেডি রাখতাম, পুজোর ক’দিন পরার জন্য । কিন্তু এখন আর পোশাকের প্রয়োজন নেই , তাই নতুন করে পোশাক বানানোর উৎসাহ ছিল না এবারের পুজোতে। এখন আবার পোশাক বানানোও অনেক ঝক্কির কাজ, কারন নতুন পোশাক বানিয়ে এনে তাকে স্যানিটাইজ করে ধুয়ে তারপর রাখার পালা। জানি না কবে এই অতিমারির কবল থেকে মুক্ত হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে প্রানভরা নিশ্বাস নিতে পারবো!”
বেহালা শীলপাড়া নিবাসী বসন্ত দেব মুখার্জির কথায়, ” গত প্রায় দু বছর এই করোনা সংক্রমণের ফলে বহু মানুষ কাজ হারিয়ে আর্থিক দুর্দশায় জর্জরিত। আমিও এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী । আমার গাড়ির ব্যবসা , কিন্তু দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি। আবার ট্যুরিস্ট গাড়িও দীর্ঘদিন বন্ধ । তাই পুজোর আনন্দে মেতে ওঠার মানসিকতা একেবারেই ছিল না । তাছাড়া পর পর দু বছরের পুজোই সংক্রমণের আতঙ্কে নানা বিধিনিষেধ মেনে হয়েছে । সেজন্য আমাদের মতো বয়স্কদের ,প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে প্রতিমা দর্শন না করাই আমার ঠিক মনে হয়েছে । তাই এ বার অষ্টমীর দিন পাড়ার প্যান্ডেলে গিয়ে একটু অঞ্জলি দেওয়া, ব্যস এই পর্যন্তই ছিল আমার কাছে পুজোর আনন্দ। তবে আমি শিব ভক্ত। বাড়িতে একটা শিব মন্দির ও আছে । সেখানেই রোজ নিষ্ঠাসহ পুজো করে সমস্ত দেবতাদের উদ্দেশ্যে আমার ভক্তি প্রদান করেছি। আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছি যে, এই জগতকে বিপন্মুক্ত করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দাও। ”
কলকাতা পুলিশের বয়স্কদের জন্য তৈরি সংস্থা ‘প্রণাম ‘ – এর এক সদস্যে চির রঞ্জন দাস বললেন, ” দু বছর আগেও ‘প্রণাম ‘ থেকে যখন সব সদস্যদের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত, সব বড় বড় পুজো কমিটির ঠাকুর দেখতাম । সবাই মিলে খুব আনন্দ হতো। কিন্তু দু বছর ধরে সবই বন্ধ । আমি আরো কয়েকটি প্রবীণদের সংস্থার সঙ্গে জড়িত । বর্তমানে আমরা প্রবীণরা একেবারেই ভালো নেই । জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে পা মেলাতে না পেরে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত । আমরা অনেকেই স্বজন হারানোর ব্যথায় ভারাক্রান্ত । খুব সম্প্রতি আমি আমার দুজন প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি । তাই এবার পুজোর আনন্দ থেকে আমি অনেক দূরে ছিলাম । ”
এই অতিমারিতে দুর্গোৎসব পালনের ক্ষেত্রে বয়স্করা অনেকেই দূরে থেকেছেন, কিন্তু কেউ কেউ আবার বাড়ির পুজোর পরম্পরা রক্ষা করতে গিয়ে পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন , যেমন – সীমা মতিলাল জানালেন, ” আমাদের বাড়িতে বহু বছর ধরে পুজো হয় । কিন্তু গত দু বছর ধরে পুজোয় আমরা আর প্রাণখোলা আনন্দ করতে পারছি না । সব সময় একটা ভয় তাড়া করে বেড়ায় । কখনো কখনো কিছু ক্ষেত্রে দ্বিধাও ছিল । তাই ভয় – ভীতি নিয়েই এ বছরের পুজো সম্পন্ন হয়েছে । এবার পুজোয় নিমন্ত্রিতের সংখ্যা ছিল খুব কম । একমাত্র পরিবারের নিকটাত্মীয়রাই এই পুজোয় উপস্থিত ছিলেন । কাউকেই আমরা আসার জন্য জোর করি নি, যারা এসে ছিলেন তারা স্ব- ইচ্ছায় এসেছিলেন । আমাদের পুজোর পুরোহিতদের দুটো ভ্যাকসিন হয়ে গিয়েছিল । সকলেই স্যানিটাইজেশনের পরই পুজো প্রাঙ্গণে এসেছেন এবং সামাজিক দূরত্বও বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন । তবে এই সময় টেলিভিশনের পর্দায় সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার খবরে আবার বুক কেঁপে উঠেছে । তখন শুধু মনে মনে মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছি , মা এই জগতকে তুমি রক্ষা করো ।”
সংক্রমণের ভয়ে সব বয়স্করাই যে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন তা কিন্তু নয়, কিছু ব্যক্তির দুটো ভ্যাকসিনই হয়ে যাওয়ায় তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে । আর সেই বিশ্বাসেই তারা যেমন ঘুরতে বেড়িয়ে পড়েছেন দর্শনীয় স্থানে , তেমনি পুজোর সময়ও ঘুরে বেড়িয়েছেন এক প্যান্ডেল থেকে অন্য প্যান্ডেল । এই রকমই একজন আত্মবিশ্বাস ভরপুর প্রবীণ হলেন কণকেন্দ্র মোহন চৌধুরী, তাঁর কথায়, ” আমার বয়স ৮২ হলেও আমার মনোবল খুবই শক্তিশালী । বলা যায় মনের দিক থেকে একদম তরুণ । তাই দুটো ভ্যাকসিন নেওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নিই পুজোর সময় পরিবারের সঙ্গে পুরী ঘুরতে যাবো। কোন রকম ভয় গ্রাস করে নি। বরাবরই আমি একটু সাহসী । পুরীতে ঘুরতে গিয়ে আমরা মাস্ক ও স্যানিটাইজারকে সর্বক্ষণের সঙ্গী করে নিয়েছিলাম । তবে ওখানে গিয়ে অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, ট্যুরিস্টরা সচেতন হলেও ওখানকার স্থানীয়রা কিন্তু সংক্রমণের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন বলা চলে । আমাদের এখানে স্বাস্থ্য দফতর থেকে যে ধরনের প্রচার চলে, ওখানেও সেরকম প্রচার হওয়া দরকার বলে আমার মনে হয়। আমরা ভ্রমণকালে কোভিড প্রটোকল পুরোপুরি মেনে চলেছি। “
শুধু ভ্রমনের ক্ষেত্রেই নয়, পুজোর সময় সল্টলেক নিবাসী এই প্রবীণ যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ” আমাদের বাড়ির পাশেই সল্টলেকের বড় একটা পুজো হয় । সেখানে আমি অঞ্জলি দেওয়া থেকে শুরু করে সন্ধ্যারতি , সন্ধিপুজো দেখা কোন কিছুই বাদ দিই নি। রাতে গাড়ি করেও অনেক ঠাকুর দেখেছি । তবে ঠাকুর দেখা ও বেড়াতে যাওয়া যাই করি না কেন, কিছু মানুষের জন্য মনের মধ্যে একটা টনটনে ব্যথা অনুভব করি। বর্তমান অতিমারি পরিস্থিতিতে বহু মানুষ আর্থিক দুর্দশা কবলিত, তারা আনন্দ করা তো দূরের কথা পেট ভরে দুবেলা খেতে পারছে না । আমাদের সকলের উচিত তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। আমিও বরাবরই পিছিয়ে যাওয়া মানুষদের কিছুটা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এসেছি , এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি ।”
বয়স্করা যে ভাবেই কাটান না কেন, পুজো অতিক্রান্ত হওয়ার পর এখন সবার উদ্বিগ্ন নজর করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের দিকে । এবার সময়ই বলবে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করে আছে !
Be First to Comment