————-জন্মদিনে স্মরণঃ গোষ্ঠ পাল————
বাবলু ভট্টাচার্য : ময়দানে ‘চাইনিজ ওয়াল’- বলে খ্যাত, ভারতের জাতীয় ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক, ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত মোহনবাগানের রত্ন গোষ্ঠ পাল বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের এক চির পরিচিত নাম। গোষ্ঠ পালের বাবা শ্যামলাল পাল ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল ছিল গোষ্ঠ পালের প্রেম। তাই তার বাবাও তাকে বাধা দেননি।মাত্র ১১বছর বয়সেই তিনি কলকাতার একটি ক্লাবে খেলার সুযোগ পান। ১৯০৭ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার কুমারটুলি ক্লাবে খেলেছেন। ১৯১১ সালে মোহনবাগান প্রথম আইএফএ শিল্ড জয়লাভ করে। আইএফএ শিল্ড-এর সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে কালীচরণ মিত্র কুমারটুলি ক্লাবে যান খেলা দেখতে। তিনি ছিলেন আইএফএ শিল্ডের পরিচালন সমিতির ভারতীয় সদস্য। সেদিনের বৃষ্টিস্নাত দিনে গোষ্ঠ পালের ভয়ডরহীন ফুটবল দাগ কেটেছিল তার মনে। তিনি গোষ্ঠ পালকে নিয়ে যান এরিয়ান ক্লাবের অধিকর্তা দুখিরাম মজুমদারের কাছে। তারপর বাকিটা ইতিহাস।
এরপর মোহনবাগানের খেলোয়াড় রাজেন সেনগুপ্ত এবং মেজর শৈলেন বসুর সাহায্যে গোষ্ঠ পাল ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগানে যোগ দেন। তার পজিশন ছিল রাইট ব্যাক। ১৯২১ সালে গোষ্ঠ পাল মোহনবাগানের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। এরপর টানা পাঁচ বছর তিনি মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯২৩ সালে তাঁর অধিনায়কত্বে মোহনবাগান দ্বিতীয়বার আইএফএ শিল্ড জয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও ৩-০ গোলে পরাজিত হয়। ওই বছরেই মোহনবাগান গোষ্ঠ পাল-এর অধিনায়কত্বে প্রথম ভারতীয় ফুটবল ক্লাব হিসাবে রোভার্স কাপে খেলার সুযোগ পায়।১৯২৪ সালে গোষ্ঠ পাল ভারতীয় জাতীয় দলেরও অধিনায়কত্ব পান। এরপর ১৯২৫ সালে মোহনবাগান গোষ্ঠ পালের অধিনায়কত্বে প্রথম ভারতীয় ফুটবল ক্লাব হিসাবে ডুরান্ড কাপে খেলার সুযোগ পায়। ভারতীয় দল নিয়ে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহলে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) যান। ফুটবল ছাড়াও তিনি হকি, ক্রিকেট ও টেনিস খেলতেন। চারটি খেলাতেই তিনি মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন। মোহনবাগান না ছাড়লেও তিনি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে একটি ম্যাচ খেলেছিলেন। ১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গলের প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরেই শ্যাম পার্কে এক প্রতিযোগিতায় লাল-হলুদ জার্সি গায়ে খেলেন গোষ্ঠবাবু। খেলার সময় বুটপরা ইউরোপিয়ান খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে গোষ্ঠ পাল খালি পায়ে খেলে প্রতিরোধ করতেন। পরাধীন ভারতে সবুজ-মেরুন রঙের জার্সি গায়ে মোহনবাগান রক্ষণে তার বিক্রমকে ভয় পেত বুট পরা ইংরেজ ফুটবলাররাও।
১৯২৮ সালে ইস্টবেঙ্গল তাকে ১ লক্ষ টাকা ও পার্ক স্ট্রিটে বাড়ি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। যদিও টলানো যায়নি তাকে। গোষ্ঠ পাল মোহনবাগান সম্পর্কে বলতেন ক্লাব হল তাঁর মায়ের মতো। গোষ্ঠ পালের পরিবারকে ব্রিটিশরা চৌধুরী উপাধি দিলেও গোষ্ঠ বাবু নিজে সে উপাধি ব্যবহার করেননি। ১৯১১ সালে মোহনবাগান আইএফএ শিল্ড জেতার পর বাংলায় মোহনবাগানকে নিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হয়। ব্রিটিশরা তা মেনে নিতে পারতো না। তাই ১৯১১ সালের পরবর্তী সময়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করতেন রেফারিরা। কিন্তু তারপরেও ব্রিটিশরা গোষ্ঠ পালের খেলার ভক্ত ছিলেন। দৈনিক ইংলিশম্যান তাঁকে ‘চিনের প্রাচীর’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। ভারতবর্ষের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ, গোষ্ঠ পালের খেলা দেখতে মাঠে আসতেন। তাঁর মাঠ থেকে সরে যাওয়ার কারণ ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই। একটি ম্যাচে ব্রিটিশ রেফারির পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের প্রতিবাদে মাঠেই শুয়ে পড়েন গোষ্ঠবাবু। এই কারণে তাকে সাসপেন্ড করে আইএফএ। সে কথা জানতে পেরে খেলাই ছেড়ে দেন তিনি। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে গোষ্ঠ পাল ভারত সরকার দ্বারা ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনিই ছিলেন প্রথম ফুটবল খেলোয়াড় যিনি পদ্মশ্রী পান। মোহনবাগান ক্লাব ২০০৪ সালে তাঁকে ‘মোহনবাগান রত্ন’ (মরণোত্তর) উপাধিতে ভূষিত করে। কলকাতায় ইডেন গার্ডেন্সের বিপরীতে তার একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে এবং ওই রাস্তাটি ‘গোষ্ঠ পাল সরণী’ নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে ভারত সরকার গোষ্ঠ পালের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাঁর নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেন। তিনিই প্রথম ফুটবলার যার নামে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়।
১৯৭৬ সালের ৮ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
গোষ্ঠ পাল ১৮৯৬ সালের আজকের দিনে (২০ আগস্ট) বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment