” বিশ্বকর্মা ” ( VISHAKARMA )!
——————————————–
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
“ওঁ বিশ্বকর্মন্ মহাভাগ সুচিত্রকর্মকারক্ ৷
বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃক্ ত্বঞ্চ রসনামানদন্ডধৃক্ ৷”
“বিশ্বকর্মা ” , দেবশিল্পী ৷ “বেদে” বিশ্বকর্মাকে সনাতন পুরুষ বা অজাত বলে বলা হয়েছে ৷ তিনি বিশ্বস্রষ্টা ও সর্বজ্ঞ ৷ “ধামানি বেদ ভুবনানি বিশ্বা” অর্থাৎ তিনি সবার অন্তরে বাস করেন ৷ “বিশ্বকর্মা , বিশ্বতশ্চক্ষুঃ , বিশ্বতোমুখ , বিশ্বতস্পাৎ ও বিশ্বতোবাজ বা সর্বত্র তিনি ৷ তিনি স্রষ্ট বা ধাতা ও বিধাতা ৷ সৃষ্টির মূল কাজ করেন ব্রহ্মরূপ বিশ্বকর্মা ৷ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে তাঁর জন্ম ৷আবার পুরাণে বলা হয়েছে শাপভ্রষ্ট হয়ে বিশ্বকর্মা ধরাধামে অবর্তীণ হন ৷ তাঁর বাবা অষ্টম বসুর অন্যতম প্রভাস লেখা আছে ৷ মা বৃহস্পতির বোন যোগসিদ্ধা বা বরবর্ণিনী বা ভূবনা ৷ তিনি “দেবানাং কার্য্যসাধকঃ” বা দেবতাদের সব কাজ সাধন করেন ৷”কর্ত্তা শিল্প সহস্রাণাম্ ” বা হাজার হাজার শিল্পের অধিপতি ৷ তাঁকে পুজো করলে ত্বষ্টা বা অগ্নি বা সূর্য্য বা ইন্দ্র পুজোর ফল মেলে ৷ নিজের মঙ্গল কামনা ও নিজেকে রক্ষার জন্য বিশ্বকর্মাকে হবি প্রদানের কথা বেদে আছে ৷ “বিশ্বকর্মাণসূতয়ে মনোযুজং বাজে অদ্যা হুমেব”(কৃষ্ণযজুর্বেদ ৪|৪|৬|২ )৷ ঋক্ বেদে যেহেতু তাঁকে স্বয়ম্ভু বলা হয়েছে ৷ ঋক বেদকে তাই স্থাপত্য বেদও বলে৷ হিন্দুদের অধিকাংশ পুজো পার্বণ চাঁদের গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করলেও বিশ্বকর্মা পুজো হয় সূর্যের গতিপ্রকৃতি অনুসারে৷ এই সময় সূর্য সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে এলে উত্তরায়ণের সূচনা হয় ৷ এর ফলে দেবতার ঘুম থেকে জেগে ওঠেন ৷ এই দিনটিকে বলে কন্যা সংক্রান্তি ৷ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি বা শেষ দিন ৷ আবার অন্যমতে , তাঁর জন্ম বা বিশ্বকর্মা জয়ন্তী মাঘ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী ৷ ঐসময় বা ঐ দিন মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে পুজো হয় ৷ কোথাও কোথাও দেওয়ালির পর গোবর্ধন পুজোর সাথে বিশ্বকর্মা পুজো হয় ৷ কেরালায় গণেশ চতুর্থীর পরদিন ঋষি পঞ্চমীতে তাঁর পুজো হয় ৷ আমরা নির্দিষ্ট দিন সৌর বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বাংলা বছরের ভাদ্র সংক্রান্তিতে বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর পুজো করি ৷ এদিন বাংলার অনেক জায়গায় পালিত হয় মনসা পূজা , লক্ষ্মী পুজো ও রান্না পূজা বা অরন্ধন ৷ অনেক জায়গায় ১৮৫০ সাল থেকে হয় ঘুড়ি উৎসব ৷ বিশ্বকর্মা পূজা শিল্পের দেবতা বা দেবশিল্পীর পুজো অন্য পুজোর মত চাঁদের গতি প্রকৃতি তিথি অনুসারে হয় না ৷ ভাদ্র সংক্রান্তির এই দিনে কোথাও লক্ষ্মী পূজা , রান্না পূজাও হয়৷ মানুষ ঘুড়ি উড়িয়ে আকাশের দেবতাকে স্মরণ করে ৷ আমরা জানি পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া বিশ্বকর্মা ও তাঁর পত্নী শাপভ্রষ্ট দেব নর্তকী ঘৃতাচির নয়টি সন্তান ৷ একেক জীবিকা অর্জনে পারদর্শী ৷ তিনি তাঁর নয় ছেলেকে ভিন্নভিন্ন শিল্পকলার প্রশিক্ষণ দেন ৷ যেমন কাংস্যকার কংস বা কাঁসা শিল্প , শঙ্খকার শঙ্খ বা শাঁখা শিল্প , সূত্রধরকে দারু অর্থাৎ কাষ্ঠশিল্প, কুবিন্দক বা তন্তুবায় বয়ন বা সুতো শিল্প , কর্মকার লৌহশিল্প , কুম্ভকার মৃৎ শিল্প , স্বর্ণকার স্বর্ণ বা অলংকার শিল্প এবং চিত্রকর অঙ্কন শিল্প ৷ এঁদের মধ্যে বড় ছেলে মনু -লোহার কারিগর , মেজ সনাতন কাষ্ঠশিল্পী , সেজো ত্বষ্টা হলেন ধাতু শিল্পী, চতুর্থ পত্না – ভাস্কর এবং ছোট ছেলে সূপর্ণ স্বর্ণ শিল্পী ও মণিকার ৷ এঁদের উত্তরসূরীদের থেকে আজকের শিল্পী সম্প্রদায়গুলির সৃষ্টি বলে মনে করা হয় ৷ বিশ্বকর্মাকে তাই আদি জেনে বিভিন্ন শিল্পী সম্প্রদায় তাঁদের বাড়ী বা কারখানায় আরাধ্য হিসাবে পুজো করেন ৷ বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র ,শিবের ত্রিশূল ,ইন্দ্রের বজ্র , কার্তিকের শক্তি, যমের কালদন্ড , দুর্গার কুঠার সহ দেবতাদের অস্ত্রশস্ত্র তিনি নির্মাণ করেছেন৷ পুরীর জগন্নাথের অসম্পূর্ণ মূর্তিও তাঁর তৈরী ৷ রথ , প্রাসাদ তৈরী শুধু নয় সব শিল্পকর্মের তিনি স্রষ্ঠা ৷
তিনি সত্য, ত্রেতা , দ্বাপর ও কলির উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য গুলি করেছেন ৷ স্বর্গপুরী , ইন্দ্রপুরী , বিশ্ব ব্রহ্মান্ড , কুবের র অলকাপুরী , শিবপুরী , দ্বারকাপুরী , হস্তিনা পুরী , সুদামাপুরী , পান্ডবপুরী ,কুঞ্জর পর্বতে অগস্ত্য মুনির ভবন ইত্যাদি নির্মাণ করেন ৷ তিনি শিবের জন্য “হরধনু ” করে দিয়েছিলেন ৷ যা দিয়ে শিব স্বর্গ , মর্ত্য ও পাতাল জয়ী ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন ৷ যে হরধনু ভেঙে রামচন্দ্র সীতাকে বিয়ে করেন ৷ আবার বিষ্ণুকে যে ধনুর্বাণ দিয়েছিলেন ৷ তা দিয়ে পরশুরাম ২১ বার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয় শূন্য করেন ৷ নৈমিষারণ্যে ধ্যানরত দধিচি মুনি দেবতাদের জন্য ইচ্ছামৃত্য বরণ করলে তাঁর হাড় বা অস্থি দিয়ে বিশ্বকর্মা বজ্র বানিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে দেন ৷ মহিষাসুর বধের বাধা দূর করতে মা দুর্গাকে কবচকুন্ডল করে দেন ৷ কার্তিকের শক্তি অস্ত্র , বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রও তাঁর তৈরী ৷ প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থ ঘাঁটলে দেখা যায় আকাশে চলা বিমানের ধারণা ও উদ্ভাবন বিশ্বকর্মার ৷ যে পুষ্পক রথে করে রাবণ সীতাকে অপহরন করে নিয়ে যায় ৷ সেই পুরাকালের বিমান পুষ্পক রথও তাঁর করা ৷ বিশ্বকর্মারই এক ছেলে ময়দানব ( ভক্ত প্রহ্লাদ কন্যা বিরোচনার গর্ভজাত) রাবণের সোনার লঙ্কা তৈরী করেছিলেন ৷ বিশ্বকর্মার আরেক ছেলে নল ( বানর স্থপতি)সাগরের উপর দিয়ে রামসেতু নির্মাণ করেছিলেন ৷ স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী বৃত্রাসুর বিশ্বকর্মার পুত্র ৷ বিশ্বকর্মা কৃষিকাজের জন্য লাঙ্গল তৈরী করেন৷ বিশ্বকর্মা রচিত স্থাপত্য শিল্প বিষয়ক গ্রন্থ হল “বাস্তুশাস্ত্রম” ৷ বস্তু থেকে এসেছে বাস্তু ৷ যার মানে পৃথিবী দেবতা , দানব , মানব থেকে সব প্রাণীর আবাসই হল বাস্তু ৷তাঁর লেখা দশটি পুঁথি পাওয়া যায় ৷ যেখানে বলা হয়েছে ,” বাস্তুশাস্ত্রং প্রবক্ষ্যামি লোকানাং হিতকাম্যায়া ” ৷ বিশ্বকর্মাবাস্তুশাস্ত্রম বইয়ে লেখা একটা কথা না বলে পারছি না ৷ “কাষ্ঠং নো ভক্ষ্যতে কুটের্যদি পক্ষং ধৃতং জলে “৷ অর্থাৎ কাঠ কাটার পর পনেরো দিন জলের মধ্যে ভিজিয়ে রাখলে তাতে পোকা ধরে না ৷বিশ্বকর্মার হাতে থাকে পরিমাপ বা মান দন্ড ৷ আসলে এই দাঁড়ি পাল্লার একদিক হল জ্ঞানের আর অন্যদিক কাজ বা কর্মের প্রতীক ৷”স্বয়ং যজস্ব তন্বং বৃধান বা “বিশ্বযজ্ঞে ” নিজেকে আহুতি দিয়েছিলেন বলে তিনি “বিশ্বকর্মা ” ৷ তিনি একাধারে “ধাতা” বা সৃষ্টিকর্তা ৷ অন্যদিকে “বিধাতা ” অর্থাৎ পালনকর্তা ! ব্রহ্মা ও বিশ্বকর্মা সৃষ্টির দুটি দিকের জাগতিক প্রকাশ ৷ ব্রহ্মা হলেন মননশক্তি আর বিশ্বকর্মা কর্মশক্তি ৷ আসলে আমরা হিন্দুরা একই ঈশ্বরকে জাগতিক নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে একেক ভাবে দেখেছি ৷ জগৎপিতা ব্রহ্মা সৃষ্টি পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করেছেন বিশ্বকর্মান বা বিশ্বকর্মা রূপে৷ সনাতন ধর্মে সৃষ্টিশক্তির দেবতা ৷ ব্রহ্মান্ডের দিব্য স্রষ্টা বা অস্তিত্বমান স্থপতি ৷ সর্বস্রষ্টা , সর্বদর্শী ও সর্বজ্ঞ ৷ “ধামানি বেদ ভুবনানি বিশ্বা” বা বিশ্ব সংসারের সবকিছুই তিনি জানেন ৷ কারণ তিনিতো অন্তর্যামী ৷ তাঁর চোখ , মুখ , হাত , পা সর্বদিকে পরিব্যপ্ত হয়ে আছে ৷ দেবশিল্পীকে বলে “মহাবীর” ৷ হাতি সবচেয়ে বলবান ৷তাই কর্মঠ হাতি তাঁর বাহন ৷ হাতির মৃদু মন্দ গম্ভীর গতিকে বলে “গজেন্দ্র গমন” ৷ তাই “কর” বা শুন্ড যুক্ত সবচেয়ে বড় স্থলচর প্রাণী “করি” বা হাতি হয়েছে শিল্প সৌন্দর্যের রূপকার বিশ্বকর্মার বাহন ৷ শোনা যায় কর্মকার সমাজের নেতা কলকাতার হরষিত কেশরী রায় প্রথম হাতিকে বিশ্বকর্মার বাহন করে পুজো করেন ৷
বিশ্বকর্মার হাতে থাকে দাঁড়িপাল্লা ৷ এর মাধ্যমে তিনি প্রতিটি মানুষকে শিক্ষা দেন আমাদের জীবনের কাঁটা সমান অর্থাৎ আত্মিক বিন্দুতে স্থির রাখা উচিত ৷ দুই পাল্লার একদিকে জ্ঞান অন্যদিকে কর্ম সমানভাবে রাখতে হয় ৷ জ্ঞান বা কর্ম যেকোন একটিকে অবহেলা করলে জীবনে দুঃখ নেমে আসে ৷ হয় আধ্যাত্মিক অকল্যাণ ৷ যা থেকে আসে বিশ্ব প্রেম ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব৷ আমার লেখা “সনাতনী কৃষ্টিকথা ” এবং “হিন্দু ধর্ম “বইদুটি পড়ুন ও পড়ান ৷ জানুন হিন্দু ধর্মের ইতিহাস , ঐতিহ্য , পাল-পার্বন, তীর্থ-গ্রন্থ , দেবদেবী সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে ৷
তাঁর চার হাতে থাকে জলের কলসী ,বই , দড়ির ফাঁস ও একটি যন্ত্র ৷ মাথায় রাজ মুকুট ৷ তিনি বাচস্পতি , মনোজব, বদান্য, কল্যাণকর্মা ও বিধাতা নামেও পরিচিত ৷ তিনি ধাতা , বিশ্বদ্রষ্টা ও প্রজাপতি ৷ ঋকবেদের ১০- ম মন্ডলের ৮১ এবং ৮২ সূক্তে রয়েছে তাঁর বর্ণনা ৷অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপট্টনমে রয়েছে সুন্দর বিশ্বকর্মা মন্দির ৷
বিশ্বকর্মা যেহেতু সর্ব কর্মের হোতা ৷ তাই , ভারত ও নেপালের অনেক জায়গায় তা শ্রমিক দিবস হিসাবে দেখা হয় ৷ “দংশপাল মহাবীর সুচিত্র কর্মকারক ৷/ বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃক ত্বঞ্চ বাসনামানদন্ডধৃক ৷ ওঁ বিশ্বকর্মণে নমঃ কর্মই ধর্ম ৷ জয়তু বিশ্বকর্মা ৷ তাই তাঁকে করজোড়ে প্রণাম জানাই ৷”দেবশিল্পী মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক ৷/ বিশ্বকর্মান্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদায়ক “৷ বাংলা অর্থ দেবশিল্পী , দয়া সহ আটটি গুণ যুক্ত দেবতাদের কারু কার্য্যসাধক সর্বাভীষ্ট প্রদানকারী হে বিশ্বকর্মা আপনাকে জানাই প্রণাম ৷
এই ছবিটি ২০২৩ এর বেঙ্গল শেল্টার কোম্পানির পুজোর।
Be First to Comment