ডঃ বিবেকানন্দ চক্রবর্তী: শিক্ষাবিদ, ১৯জুন, ২০২০। সুশান্ত সিং রাজপুত-এর আত্মহত্যার কারণ, মানসিক অবসাদ বলে মনে করা হচ্ছে। যে কোনো সমাজে আত্মহননের ঘটনা মর্মান্তিক। আত্মহত্যা ব্যক্তির স্ব-অস্বীকারের স্ব-বিরোধ। মনের আবেগীয় বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলার এক অস্বাভাবিক ক্রিয়া।
আত্মহত্যা মানব-দৃষ্টিতে এক ট্র্যাজেডিঃ
১) আত্মহত্যা সবক্ষেত্রেই দুঃখজনকভাবে অ্যামবিভ্যালেন্ট-বিপরীত বিরুদ্ধ মানসিকতার একই কালে উপস্থিতি, দ্বিধার টানে মুহ্যমান, দ্বন্দ্বাক্রান্ত।
২) একান্ত একা একা থাকার সময় এবং তীব্র মানসিক যন্ত্রণা, উৎকন্ঠা ও মানসিক চাপে।
৩) বাস্তব অবস্থা ও তার মূল্যায়নে ব্যর্থতা।
৪) কোন সমস্যার সমাধান সূত্র সম্পর্কে না ভেবে কেবল সমস্যা-কে ভাবা ও সমস্যা থেকে কোনদিন বেরিয়ে আসা যাবেনা এমনি উপলব্ধি।
৫) বেঁচে থাকাটা অর্থহীন এমন মনে হওয়া।
অবসাদগ্রস্ত মানুষকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবেঃ-
১) আন্তরিকভাবে জানতে হবে দুঃখ-কষ্টের কারণ, কাউন্সেলিং করতে হবে।
২) মনোরোগ চিকিৎসকের চিকিৎসার অধীনে থাকতে হবে। ওষুধ খেতে হবে নির্দেশমতো।
৩) ইতিবাচক ভাবনা মস্তিষ্কে দিতে হবে।
৪) প্রতিদিন ধ্যান ও প্রাণায়াম করতে হবে।
৫) বাম ও দক্ষিণ-দুই মস্তিষ্কের কাজ সম্পর্কে জানতে হবে।
দক্ষিণ মস্তিষ্ক প্রধানত মননশীল চর্চা, অনন্তের ভাব, প্রভৃতি পবিত্র এবং স্বজ্ঞালব্ধ বিষয়ের অনুশীলন করে থাকে। স্বজ্ঞালব্ধ মস্তিষ্কের ক্রমোন্নতি ভবিষ্যৎকে দর্শন করতে পারে। এটিই হচ্ছে ধ্যানের প্রধান ফলাফল। দক্ষিণ মস্তিষ্ক স্বতঃলব্ধ জ্ঞান, উচ্চতর চিন্তা, উচ্চতর মূল্যবোধকে করায়ত্ত করতে সাহায্য করে। বাম গোলার্ধের মস্তিষ্ক আমাদের বিচারশীল, যুক্তিবাদী, হিসাবী, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং ভয়ঙ্করভাবে আত্মপর এবং ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় বিশারদ করে তোলে। Danah Johar তাঁর বই Spiritual Intelligence-এ জানাচ্ছেন, ‘বাম মস্তিষ্ক দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিদের উন্নাসিক জীবনচর্যায় ধাবিত করে, নিম্নতম সংস্কৃতি চর্চার ভিড়ে সামিল করে। এরা ইন্দ্রিয়ভোগের সুখের তাড়নায় ছুটে চলে।
ভোগ-সুখ-আনন্দ এই মতবাদে পুষ্ট হয়ে যখন তারা আরও ভোগবাদী হয়ে ওঠে তখন তারা হতাশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয় এবং পরিশেষে তারা ফলাফলস্বরূপ স্নায়বিক রোগের শিকার হয়ে পড়ে। ভারতীয়গণ হাজার হাজার বছর পূর্বে এই অভিজ্ঞতার কথা জানতে পেরেছিলেন’।
মস্তিষ্কের দক্ষিণ ভাগ যেহেতু আধ্যাত্মিক সংস্কৃতিকে ক্রিয়াশীল করে, এর দ্বারা পরিচালিত মানুষ তখন নানা গুণে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করে। যেমন— সর্ব জীবের প্রতি ভালবাসা, সেবা, সম্মান, নম্রতা, অহিংসা— এই গুণগুলিই তাঁকে উচ্চতর, শক্তিশালী এবং আনন্দময় জীবন দান করে।
ভারতীয় দর্শন বলেন, “পরাবিদ্যা” অপরাবিদ্যার পরিচালক হবে। বস্তুতান্ত্রিক জ্ঞানের উৎকর্ষতা দিয়ে শারীরিক বাধা-বিঘ্নগুলিকে দূর করা যায়। আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ অর্জন করে একজন অনন্ত শক্তির আকর হয়ে, অন্তর্নিহিত অনন্ত পরমাত্মাকে অনুভব করতে পারবেন।”
ঈশ উপনিষদ জানাচ্ছেন,
“অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে।”
স্বামী বিবেকানন্দ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে ‘পূর্ণ’ মানুষ আছে সেই মনুষ্যত্বের ক্রমোন্নয়নের চারটি পথের সন্ধান দিয়েছেন। কী সেই পথ, যার দ্বারা আমাদের আধ্যাত্মিক ভাব ও পবিত্র চিন্তাকে সমৃদ্ধ করতে হবে?
আমাদের কর্মময়, গতিশীল এবং বাইরের বিজ্ঞান সম্পর্কে অনুশীলনরত হতে হবে। চারটি পথ হলোঃ (১) জ্ঞান (পবিত্র চিন্তা), (২) উক্তি (অর্থাৎ মানবজাতির মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা), (৩) সেবা (ঈশ্বর জ্ঞানে—জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সেবা), (৪) পরিশেষে ধ্যান। এই ধ্যান হবে,অন্তর্নিহিত আত্মাকে কেন্দ্র করে, যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির মূলীভূত কারণ।
ডঃ বিবেকানন্দ চক্রবর্তী, শিক্ষাবিদ।
Be First to Comment