Press "Enter" to skip to content

বিভিন্ন রেঞ্জের বহুমাত্রিক সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। চরিত্র যেমনই হোক, অভিনয়ের সময় নওয়াজুদ্দিন চেষ্টা করেন প্রতিটি চরিত্রের ভিতরে প্রবেশ করতে……।

Spread the love

শুভ জন্মদিন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী

বাবলু ভট্টাচার্য : তাকে আমরা ‘লাঞ্চবক্স’ চলচ্চিত্রে একজন প্রান্তিক অফিস সহকারী হিসেবে দেখছি। ‘বাজরাঙ্গি ভাইজান’ ছবিতে দেখেছি একজন খাস-দিল সাংবাদিক হিসেবে। আবার ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুরে’ দেখেছি একজন গ্যাংস্টার হিসেবে। রামান রাঘব ২.০ ও বাদলাপুরের মতো ছবিতে দেখেছি সিরিয়াল কিলারের চরিত্রে।

বিভিন্ন রেঞ্জের বহুমাত্রিক সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। চরিত্র যেমনই হোক, অভিনয়ের সময় নওয়াজুদ্দিন চেষ্টা করেন প্রতিটি চরিত্রের ভিতরে প্রবেশ করতে।

আজকের এই সমাদরের পেছনে রয়েছে অনেক বছরের সাধনা, কঠোর পরিশ্রম এবং অভিনয়ের প্রতি নিজের ভালোবাসা। ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’, ‘বাদলাপুর’, ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ কিংবা অস্কার মনোনীত ছবি ‘লায়ন’-খ্যাত এই তুখোড় অভিনেতা উঠে এসেছেন একদম শূন্য থেকে।

বাবা ছিলেন কৃষক। পরিবারের ৯ ভাই বোনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বড়। যে গ্রামে নওয়াজের জন্ম, সেটি এতই পশ্চাৎপদ যে সেখানকার লোকজন সম্বন্ধে নওয়াজুদ্দিন বলেছিলেন, এখানকার লোকজন শুধু তিনটি জিনিস চেনে। আখ, গম আর বন্দুক। এই পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে জন্ম নিয়েও নওয়াজুদ্দিন বড় কিছুর স্বপ্ন দেখেছিলেন।

নিজের গ্রাম এবং আশেপাশের সাত গ্রামের প্রথম গ্রাজুয়েট হিসেবে কেমিস্ট্রিতে অনার্স করেন নওয়াজ। গ্রাজুয়েশন শেষ করে বারোদার একটি পেট্রো-কেমিক্যাল কোম্পানিতে কেমিস্ট হিসেবে চাকরিও নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে মন টিকলো না। চলে এলেন দিল্লী। চাকরির খোঁজে যখন দিল্লী ঘুরছেন, তখন একজনের কথায় একদিন থিয়েটারে গিয়ে একটি মঞ্চনাটক দেখলেন। মঞ্চনাটক দেখে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে তার কাছে মনে হল, এই অভিনয় করার জন্যই তার জন্য হয়েছিল।

মঞ্চে কাজ করা শুরু করলেন। মঞ্চে কাজ করে থাকা- খাওয়ার খরচ মিলত না। অপারগ হয়ে নওয়াজুদ্দিন সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নিলেন। সারাদিন গার্ডের দায়িত্ব পালন করতেন। রাতে চলে যেতেন থিয়েটারে। এক-দেড় বছর এভাবে চলার পর নওয়াজ অ্যাডমিশন পেলেন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে (এনএসডি)।

১৯৯৬ সালে এনএসডির গ্রাজুয়েশন শেষে পাড়ি জমালেন বোম্বেতে। প্রথমে নাটকের জন্য ধরনা দিলেন। ভাগ্য খুললো না। চেহারা দেখেই তাকে বাদ দিয়ে দেয়া হল। ধরনা দিলেন সিনেমার রোলের জন্য। সেখানেও প্রায় একই অবস্থা।

অভিনয় না দেখে চেহারা আর শরীরের অবয়ব দেখেই সবাই নাকচ করে দিতে লাগলো। তবে কিছুদিন ঘোরাঘুরির পর ছোটখাটো কিছু রোল পাওয়া শুরু করলেন। পকেটমার, ভিক্ষুক, দারোয়ান, মালীর মতো ছোটখাটো চরিত্রে কাজ করতে লাগলেন।

নওউয়াজুদ্দিনের বলিউড ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। আমির খানের ‘সারফারোস‘ ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। ২০০৩ সালে রাজকুমার হিরানীর ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস‘ ছবিতেও একটি পকেটমারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ২০০৩ সালে ইরফান খানের সাথে ‘বাইপাস’ নামে একটা শর্টফিল্মে অভিনয় করেছিলেন।

এরপরই শুরু হল খরা। ছোটখাটো রোলও যেন আর মিলছিল না। আর যেসব রোল মিলত, তার জন্য পেতেন মোটে চার-পাঁচশ টাকা। হতাশ হয়ে প্রায়ই চিন্তা করতেন গ্রামে ফিরে যাবেন। বাপ-দাদার মতো ক্ষেত খামারে কাজ শুরু করবেন। কিন্তু গ্রামে গেলে আবার মানুষ ‘পরাজিত সৈনিক’ আখ্যা দেবে, এটাও মানতে পারছিলেন না। তাই বারবার গ্রামে ফিরে যাওয়ার চিন্তা মাথায় এলেও অভিনয়ের সাথেই লেগে ছিলেন।

এরই মধ্যে ২০০৮-০৯ সালের দিকে বলিউডে কিছু নতুন ধারার পরিচালকের উত্থান ঘটলো। প্রথমবারের মতো বলিউডে ইন্ডি-ফিল্ম একটি আলাদা জায়গা করে নিতে সক্ষম হল। নন্দিতা দাস, হ্যানসল মেহতা, আনুরাগ কাশ্যপের মতো পরিচালকরা লাইমলাইটে আসা শুরু করলো।

কোনো এক নাটকে নওয়াজের অভিনয় দেখে  অনুরাগ কাশ্যপ ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-তে তাকে মোটামুটি একটা বড় রোল দিয়েছিলেন। সেখানে দুর্দান্ত অভিনয় করলেও অন্য কোনো পরিচালকের নজরে পড়লেন না। অবশেষে আবার এই আনুরাগ কাশ্যপই এলেন রক্ষাকর্তা হয়ে। বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত তার গ্যাংস্টার ফিল্ম ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এ নওয়াজকে দিলেন লিড রোল।

গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের বক্স অফিস সাফল্য পেল বলিউডে মুক্তধারার চলচ্চিত্রের জন্য একটি বিজয় নিশান। সেইসাথে বিজয় নিশান উড়ল আরেকজন যোদ্ধার। বলিউডের মূলধারায় আসার জন্য নওয়াজুদ্দিনের এক যুগের সংগ্রাম ও অপেক্ষা শেষ হল।

গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের পর নওয়াজুদ্দিন বলিউডের অজস্র মুক্তধারার চলচ্চিত্রে প্রধান প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এখন মুক্তধারার চলচ্চিত্রে যেকোনো পরিচালকেরই প্রধান টার্গেট থাকে নওয়াজুদ্দিন। মুক্তধারার চলচ্চিত্র বাদে প্রচুর বাণিজ্যিক ছবিতেও অভিনয় করেছেন।

শাহরুখ খান, রনবীর কাপুরের মতো অনেক প্রথম সারির অভিনেতাই এখন এক বাক্যে তাকে বলিউডের সেরা অভিনেতা হিসেবে মেনে নেন। শুধু সহশিল্পীদের প্রশংসা আর ভক্তদের ভালোবাসাই না, দেশ-বিদেশ থেকে কুড়িয়েছেন প্রচুর সম্মাননাও।

অভিনয়ে ইতোমধ্যে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, যা শাহরুখ খান, সালমান খানদের কাছেও এখনো অধরা রয়ে গেছে। এছাড়া এশিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস, এশিয়া প্যাসিফিক ফিল্ম ফেস্টিভাল ও এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডের মতো মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র আসর থেকেও ঘরে তুলেছেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার।

কান ফিল্ম ফেস্টিভালেও প্রতি বছর তার কোনো না কোনো ছবির স্ক্রিনিং থাকেই। গত বছর যেমন থেকেছে প্রখ্যাত লেখক সাদাত হাসান মান্টোর জীবনী নিয়ে নন্দিতা দাশের নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মান্টো’।

মেথড অ্যাক্টিং করতে গিয়ে প্রায় সময়ই সিনেমার চরিত্রকে এতটা আপন করে নেন যে নিজের মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলেন কিছুটা। সিনেমার চরিত্র ও ব্যক্তি নওয়াজের ট্রানজিশনটা তাই তার জন্য অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রায়ই তাই সিনেমা শেষ করে চলে যান গ্রামের বাড়িতে। নিজের আসল সত্ত্বার দেখা পেতে।

শুধু প্রতিভা নয়, পরিশ্রম ও ত্যাগের দিক বিবেচনাতেও নওয়াজ অদ্বিতীয়। বলিউডে প্রতিষ্ঠিত এই অভিনয় সম্রাটের বহু বছরের সংগ্রামের ইতিহাস হয়তো মানুষ মনে রাখবে না। কিন্তু তার উপহার দেয়া অসাধারণ চরিত্রগুলোকে মানুষ চাইলেও ভুলতে পারবে না।

নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী ১৯৭৪ সালের আজকের দিনে (১৯ মে) ভারতের উত্তর প্রদেশের ছোট গ্রাম বুধানায় জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.