জন্মদিনে স্মরণঃ ক ম ল দা শ গু প্ত
নিজস্ব প্রতিনিধি : ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী, প্রসিদ্ধ সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত।
তিনি শুধু বাংলা গানের সুরস্রষ্টা নন, তাঁর সুরের নিবিড় পরিচর্যা পেয়েছে হিন্দি, উর্দু, মারাঠি সহ বেশ কয়েকটি ভাষার গান। প্রথিতযশা এ সঙ্গীতজ্ঞ আধুনিক গানসহ আট হাজারেরও বেশি গানের সুর করেছিলেন। সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি আধুনিক, নজরুলসঙ্গীত, গজল, ভজন, কাওয়ালিসহ সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা।
তাঁর পিতার নাম তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত। কমল দাশগুপ্তের শিক্ষাজীবন শুরু কলকাতায়। ১৯২৮ সালে তিনি ক্যালকাটা অ্যাকাডেমি থেকে ম্যাট্রিক এবং পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি কম পাস করেন।
বিদ্রোহী কবি নজরুলের সান্নিধ্য লাভ করায় বিদেশি ভাষার ওপর বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। কবি কাজী নজরুলের বহু জনপ্রিয় গানে তিনি সুর দিয়েছেন।
উত্তর ভারতের মীরার ভজনে সুরের প্রয়োগ বিষয়ে গবেষণা করে কমল দাশগুপ্ত ১৯৪৩ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব মিউজিক ডিগ্রি লাভ করেন।
কমল দাশগুপ্তের সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় অগ্রজ অধ্যাপক বিমল দাশগুপ্তের কাছে। পরে দিলীপকুমার রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁ প্রমুখের কাছে তিনি সঙ্গীতশিক্ষা করেন। তিনি বহু আধুনিক বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ঠুমরি এবং ছায়াছবির সঙ্গীতে কণ্ঠদান ও সুরারোপ করেছেন।
২৩ বছর বয়সে হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানীর সঙ্গীত- পরিচালক ও সুরকার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানীতেও কর্ম সম্পাদন করেন। এছাড়াও তিনি রেডিও অডিশন বোর্ডের প্রধান ছিলেন এবং রেডিও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের প্রধান সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি।
তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি, যিনি উর্দু ভাষায় কাওয়ালি গান পরিবেশন করেন। এইচএমভিতে এক মাসে তিপ্পান্নটি গান রেকর্ড করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। রেকর্ড-সংখ্যক গানে সুর করার জন্য ১৯৫৮ সালে এইচএমভিতে তাঁর সিলভার জুবিলি অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের মার্চিং সং ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’-এর সুর তাঁরই দেয়া। এছাড়াও হায়দ্রাবাদের নিজামের সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ গান তিনি রেকর্ড করেছিলেন।
কমল দাশগুপ্তর সুরারোপিত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘পণ্ডিতমশাই’ ১৯৩৬ সালে মুক্তি পায়। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘বধূবরণ’। এর মধ্যে ৮০টি বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি, যার মধ্যে ৫টি ছবিতে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছিলেন।
এক বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, মহৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও দুঃখীজনের বন্ধু। ১৯৪৩ সালে সারা ভারতবর্ষ যখন দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত তখন কলকাতায় ভূখা নাঙ্গা মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন কমল দাশগুপ্ত। নিজ খরচে লঙ্গরখানা খুলে প্রতি দিন একশত করে লোক খাওয়াতেন তিনি।
এ দেশের সন্তান কমল দাশগুপ্ত এক বুকভরা প্রত্যাশা নিয়ে ১৯৬৭ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে দেশের মাটিতে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর সে প্রত্যাশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। নিদারুণ হতাশা ও দুঃখ দৈন্যর মধ্য দিয়েই এ সময়কার (ঢাকার) দিনগুলি অতিবাহিত হয়েছে তাঁর। জীবিকার অন্বেষণে অর্থের প্রয়োজনে ঢাকার হাতিরপুলে ‘পথিকার’ নামে একটি ছোট স্টেশনারি দোকান খুলেছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য ১৯৫৫ সালে ৪৭ বছর বয়সে বাংলাদেশের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম নজরুল সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করেন কমল দাশগুপ্ত।
২০ জুলাই, ১৯৭৪ সালে ঢাকায় এই গুণী শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।
কমল দাশগুপ্ত ১৯১২ সালের আজকের দিনে (২৮ জুলাই) নড়াইল জেলার কালিয়া থানার বেন্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment