জন্মদিনে স্মরণঃ বিজন ভট্টাচার্য
বাবলু ভট্টাচার্য : বিশ শতকের বাংলা নাট্যকলার ইতিহাসে ট্র্যাজিক নায়কের প্রথম শিরোপা যদি শিশিরকুমার ভাদুড়ির প্রাপ্য হয়, তা হলে ওই শিরোপার দ্বিতীয় দাবিদার সম্ভবত বিজন ভট্টাচার্য।
তিনিই প্রথম বাংলা রঙ্গমঞ্চকে পুরাণ ও ইতিহাসের রোম্যান্টিক প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। তাঁর রচিত নাটকের তালিকা খুব দীর্ঘ নয়। অথচ নাট্যকার হিসেবে তাঁর কলমে শক্তি কম ছিল না। তাঁর অভিজ্ঞতা পরিধি ছিল বিশাল। উচ্চমধ্যবিত্ত জীবন থেকে গ্রামীণ চাষি বেদে শ্রমিকদের জীবন পর্যন্ত সকলের মুখের বাগ্ভঙ্গিটি তিনি অনায়াসে তুলে আনতে পারতেন। মৃত্যুর ছ’বছর আগে তাঁর নাট্যরচনার সমাপ্তি ঘটে।
ভারতীয় ‘সংসদ বাংলা নাট্য অভিধান’ অনুযায়ী তার নাট্য তালিকায় আছে : ‘আগুন’ (একাঙ্ক, ১৯৪৩), জবানবন্দী (১৯৪৩), ‘নবান্ন’ (১৯৪৪), ‘মরা চাঁদ’ (৪৮, প্রথমে একাঙ্ক, ৬০-এ পূর্ণায়িত), ‘অবরোধ’ (৪৭), ‘জতুগৃহ’ (৫১), ‘গোত্রান্তর’ (রচনা-৪৭, ১৯৫৬-৫৭), ‘ছায়াপথ’ (৬১), ‘দেবীগর্জন’ (৬৬), ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (৬৬), ‘গর্ভবতী জননী’ (৬৯-৭১), ‘আজ বসন্ত’ (৭০), ‘সোনার বাংলা’ (৭১), ‘চলো সাগরে’ (৭২)।
বিজন ভট্টাচার্য মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের জীবন সংগ্রামের কথা ও বাঁচবার কথা তাঁর নাটকগুলির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি এই ভাবনা থেকে সরে যান।
বিজন ভট্টাচার্য কিছুদিন (১৯৩১-১৯৩২) আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন এবং ১৯৩৮-৩৯ সালে তিনি আলোচনা, ফিচার ও স্কেচ লেখার কাজ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে তিনি মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘অরণি’ পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন এবং বিভিন্ন বিষয়ে লেখালিখি করতে থাকেন। ১৯৪২ সালে সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
তাঁর পিতা ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। পিতার কর্মসূত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করার সুবাদে তিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন; ফলে তাদের সংগ্রামী জীবন ও আঞ্চলিক কথ্য ভাষার ছাপ তাঁর রচিত নাটকে পরিলক্ষিত হয়।
বিজন ভট্টাচার্য ছাত্রাবস্থাতেই যুক্ত হন স্বদেশি আন্দোলনে। অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২০-২২) যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন।
নবনাট্য আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক বিজন ভট্টাচার্য গণজীবনের সংগ্রাম ও দুঃখ-দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনা, প্রগতিশীল চিন্তা ও সমাজবোধ নিয়ে নাটক রচনা করে এবং এ ক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তাঁর শেষজীবনে রচিত নাটকে মার্কসীয় দর্শন, হিন্দু ধর্ম ও দর্শন সংমিশ্রিত হয়েছে।
নাট্যজগতে বিশেষ অবদানের মূল্যায়নস্বরূপ কেন্দ্রীয় সঙ্গীত নাটক আকাদেমি, পশ্চিমবঙ্গ সঙ্গীত নাটক আকাদেমি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পুরস্কৃত করে।
১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন নাট্যজন বিজন ভট্টাচার্য।
বিজন ভট্টাচার্য ১৯১৭ সালের আজকের দিনে (১৭ জুলাই) বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার খানখানাপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment