[প্রদীপের সঙ্গে আলাপ=প্রলাপ]
(পর্ব –০৬০)
জাদুশিল্পী মঞ্চ মায়াবী পি সি সরকার জুনিয়র
(Dr.Prodip Chandra Sorcar, M. Sc., Ph. D.)
কলকাতা, ২০ এপ্রিল ২০২১।
“Bদ্যাং দদাতি Bণয়ং”
Bদ্যা শুধু B৯ ৯, দেয় B ১০, B১১…B দ্বেষ
পূর্বে প্রকাশিত (পর্ব=০৫৯) -র পর
বাবার নির্লিপ্ত চক্ষু যে কি ডেঞ্জারাস তা আমরা তিন ভাই-ই জানি। রেগে আছেন, নাকি, চোখ খুলে সামনের ব্যক্তির হৃদপিন্ডের দিকে সব ভেদ করে তাকিয়ে, ঠাণ্ডা মাথায় মেশিন গানটা কোথায় তাক করবেন ভাবছেন, নাকি এক্ষুনি হুঙ্কার দিয়ে বাড়ি কাঁপাবেন বিশাল রিখ্টর স্কেলে, বা আমাদের পড়া ধরবেন- ঠিক সেইখান থেকে, যেখানটা আমরা ফাঁকি দিয়েছি, এড়িয়ে গেছি, পড়িনি, যা কোনও জ্যোতিষীর সম্মিলিত বাহিনীও আন্দাজ করতে পারবে না। বাবা ডাকলে,আমাদের তিন ভাই-এর নাম, “মানিক, জহর, প্রভাস”, বলে, একসঙ্গে- এক নিঃশ্বাসেই হুঙ্কার দিয়ে ডাকতেন। “M-G-M “-এর ওই প্রতীকী সিংহটার গর্জনকেও সেটা হার মানাতো। বেচারা সিনেমা ছেড়ে আবার নাকি আফ্রিকায় ফিরে গিয়েছে। তাতে যে কী শব্দ-ব্রহ্ম-মন্ত্র থাকতো কে-জানে? নিমেষে সবার কল-কবজা হতো স্তব্ধ।বড়দা হয়ে যেতেন ভ্যানিশ!! বাড়িতেই নেই, বই নিয়ে স্যারের বাড়িতে নাকি গেছেন পড়তে। । ফিরতে দেরি হতে পারে। ছোটভাই প্রভাস, হামাগুড়ি দিয়ে , নীচু খাটের তলায় কি যেন কি একটা খুঁজতে ব্যাস্ত। বাবার হুঙ্কার শোনেই নি। সত্যিই তো, খাটের তলায়, দুর্ভেদ্য বাক্সারণ্যের ঠাসা চটচটে অন্ধকারের ফাঁকে কি বহির্জগতের সুপারসোনিক ‘মেগাটন’ বোমের আওয়াজ পৌঁছুতে পারে? না, পৌঁছায় না। শুধু বাড়িটা থরথর করে কাঁপে। প্রভাস বাবাকে নিজে টেস্ট করে দেখার প্রস্তাবও দেয়। বলে, “বাবা তুমি শুয়ে দ্যাখো, আমি ‘হালুম’ বলছি, তুমি শুনতে পাও কিনা দেখো, শোনা যায় না। ” প্রস্তাব শুনে, বাবা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, একটু থমকে,তাঁর অন্য আর একজন কামিকাজে ‘শহীদ’ y= mx+c ফর্মূলার জীবন্ত প্রতীক, বরবটির মতো-স্বাস্থ্য সমৃদ্ধ, তালপাতার সেপাই নামে ভূষিত, “বি.পি”.-র দিকে, অর্থাৎ ইউনিভার্সাল “কাক”-এর দিকে তাকান।
(মানে বুঝলেন না!! ভুলে মেরে দিয়েছেন !!! ঠিক আছে, আবার বলে দিচ্ছি! বি. পি হচ্ছে ” বলির পাঁঠা”, আর “কাক” মানে হচ্ছে ‘কাঠালী কলা’। আর ওই দুটোই হলাম এই মোবাইল জমানায়, ‘ভাষা-ক্ষীর-কৃত ‘আমি’নামক এই ‘মধ্যম’ , অধম। ইউনিভার্সাল হচ্ছে সর্ব ঘটে উপস্থিতির প্রতীক। )
শুনেছিলাম রাজ্য জয় করে ফিরলে ব্যাণ্ডপার্টি বাজিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। সদর্পে বাবার ঘরে ঢুকলে যে সেটা বাজবে না, তা জানা’ ছিলো , তবে আর্টস এবং সাইন্সে দুটোতেই গ্র্যাজুয়েট হওয়ার ‘বিরল’ কৃতিত্বে সামান্য একটু ভেরী- বা হুলুধ্বনীও যে বাজবে না, তা কি হয়? বাজলো। বাবা নিজেই বাজালেন। গলা-খাকারি দিয়ে পরিষ্কার কণ্ঠে বললেন, “কি ব্যাপার? খুব খুশি দেখছি”!
প্রণাম করেই দুটো প্রমাণ-পত্রের মার্ক্-শীট হাতে দিই। বলি, “আমি সাইন্স নিয়ে, আবার আর্টস নিয়েও গ্র্যাজুয়েট হয়েছি। এবার তো ম্যাজিক শুরু করতে পারি? ”
সংক্ষেপে, একটা কথায় লম্বা বাহবা লেকচারের ক্ষুদ্রতম বনসাই বানিয়ে, বাবা উপসংহারটা টেনে দিলেন। সেই বিখ্যাত নির্লিপ্ত ভাবেই বললেন, — “বোকা! ”
বোকা বলেই আমি নাকি গো-মূর্খের মতো দু-রকমের ডিগ্রী পাবার লোভে দু-জাতের শুকনো জাবর-চিবিয়েছি।
উত্তরে নাকি পাওয়া যাবে একটুখানি গোবর।
আমি থুবড়ে পড়ি।
যা ব্বাবা । এত্তো সাধ্য-সাধনা, এত্তো পাতার পর পাতা , “টা ভ্যাম্ ভিস্ / নে ভ্যাম্ ভস্/ নসি-ভ্যাম-ভস্ /……..করে, .,তারপর ‘সেক্সি-পেয়ার, রোমিও-জুলিয়েট, ‘ এট্-টু-ব্রূটে’র জুলিয়াস সিজার ডিঙ্গিয়ে, হের্ মোক্ষমূলরের সঙ্গে “আর্য্য একটি জাতি নহে, উহা একটি ভাষা,”…নিয়ে তর্ক+P. R করার পর, “উয়ারে শিয়ালে খাইয়াছে” ইত্যাদি ইত্যাদি… সব জলে গেল!! যেন দেবযানী প্রশ্ন করছেন প্রেমিক দেবতা ‘কচ’কে–” যেতেছ চলিয়া! সকলি সমাপ্ত হলো, দু-কথা বলিয়া!!?”
সবই হলো ভষ্মে ঘি ঢালা।
বাবা আমার পিঠে হাত রেখে বলেন, “চৈতন্য বিহীন ডিগ্রি পাওয়ার জন্য সময় শুধু শুধু নষ্ট করেছো, কষ্ট পেয়েছো। অবশ্য তোমার জীবনের কম্পাস যদি মাষ্টার-মশাই হওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আলাদা কথা। জাদুকর হচ্ছেন ‘WIZARD’. সেই কথাটা এসেছে, Wise mens’ Art থেকে। আমি তোমাকে আর্টস্ নিয়েও Wise man হতে বলেছিলাম। এর সাথে Degreeর সম্পর্কটা খুব গোলমেলে। পরিষ্কার মনে বুঝতে চেষ্টা করো, কোনও তর্ক নয়, Heat এবং Temperature -এর মধ্যে যে তফাৎ, জ্ঞান এবং ডিগ্রীর মধ্যেও ঠিক সেরকম তফাৎ।
–ঠিক বুঝলাম না।
–দুটো উনুনের একটাতে একটা বড় বালতি জল চাপাও, একই সঙ্গে অন্যটায় এক মগ জল চাপাও। দু- মিনিট পর একই সময়ে দেখবে বালতির জলের চেয়ে মগের জলের টেম্পারেচারটা বেশি।
— বুঝতে পেরেছি। মগের জলের টেম্পারেচার বাড়াতে উত্তাপটা যা লেগেছে, বালতিতে জল বেশি আছে বলে, উত্তাপ অনেক বেশি লাগবে ওই টেম্পারেচারে আসতে।
–Correct! আমি তোমার জ্ঞানের ভাণ্ডার বাড়াতে বলেছিলাম। ডিগ্রীর সংখ্যা নয়। Temperature নয়, Heat জমাও। যাই হোক, Congratulations. I am proud of you.
বাবাকে আমি আবার নতুন করে আবিষ্কার করলাম। ভ্যাঁ করে ছেলে মানুষের মতো কেঁদে বাবাকে আবার প্রণাম করি, বাবা আমায় জড়িয়ে ধরেন। আমি পায়ের কাছে, মেঝেতে বসি। বাবা বলতে শুরু করলেন:-
“… ম্যাজিক কিন্তু জাদুকরের হাতে, কোনও যন্ত্রে বা স্টেজের ওপর তৈরি হয়না। ম্যাজিক তৈরি হয় দর্শকের মনের মধ্যে। আমরা তো মন্ত্র-টন্ত্র দিয়ে ম্যাজিক করি না, আমরা ‘ যাদুকরের মতো’ অভিনয় করি। সেই অভিনয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আমরা যদি অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাই, তাহলে মনে যে বিশ্বাস জন্ম নেয় সেই বিশ্বাসের গভীরতা থেকে সৃষ্টি হয় এক অকল্পনীয় জগতের , মায়া বা রূপকথার জগৎ। মানুষ সেই জগতের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করতে চায়। ভালোবাসে। এই ভালোবাসা বা বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছে ঐশ্বরিক চিন্তা, ধর্ম, ভুত-প্রেত, কল্পবিজ্ঞান, ভবিষ্যতের বিজ্ঞানের হাতছানি, প্রগতি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেককিছু… হয়তো বা সব কিছুই। খুব কঠিন, গভীর এবং বিস্তৃত এই আলোচনা… ।
—আমার কিন্তু কঠিন মনে হচ্ছে না।
—সেটা তোমার কৃতিত্ব। তোমার শিক্ষা লাভের ফল, পরিচয়। তুমি যে সত্যকূল-জাত, অ-ব্রাহ্মণ নও, তার চিহ্ন। এখন তোমার মধ্যে অন্য মানুষের, সোজা কথায়, দর্শকদের ইচ্ছা, আব্দার, মুক্তিচিন্তা, কল্পনা, বিজ্ঞান-চেতনার সীমা, এই সব নিয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে, ওঁদের চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্যকে জানতে হবে। সীমানা মাপতে হবে।
—সেটা কি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখার উপায় আছে?
—না , নেই! তবে মানুষের চিন্তার ওপর বস্তু কেন্দ্রিক গবেষণা এবং সাধনা শুরু হয়ে গেছে। তার নাম হচ্ছে “ব্যবহারিক মনোবিজ্ঞান” অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি। এতে পাশ্চাত্যের মনোবিজ্ঞানীরা অনেকটাই এগিয়ে আছেন বলে দাবি করেন। তবে আমরা যে পিছিয়ে আছি, তা নয়। আমরা জাদুকরেরা, এ ব্যাপারে অ-নে-ক এগিয়ে আছি। মন কে শান্ত করতে প্রাণায়াম, ধ্যান ইত্যাদি আমরা ব্যবহার করি কিন্তু তার ওপর কোনও তত্বের গাটছড়া নেই, স্বীকৃতি নেই, এর ব্যাকরণ নেই, বিজ্ঞান-সম্মত সাধনাও নেই।
—নেই!!?? সে কি??? এতো প্রফেসর, স্বনামধন্য ব্যক্তিরা রয়েছেন!!
—তাঁরা ‘মেজাই’ নন। জাদু সম্পর্কে কোনোও গভীরতা নেই। কনসেপ্ট নেই। ‘মায়া’ সম্পর্কে কেউ কিচ্ছু জানেন না। গবেষণা করেন না। শুধু পাশ্চাত্যের একপেশে বস্তুবাদী চিন্তাতেই আটকে আছে। চাকরী করেন,গবেষণা করেন না।তোমাকে সে কাজটা করতে হবে।
—আমি!!??!! আমি তো কিছুই জানিনা। আমি পারবো??
—হ্যাঁ পারবে। পারতেই হবে। এটা আমার আদেশ।
ছলে, বলে কৌশলে, অমৃতলাভ করতেই হবে। প্রথমে তোমায় অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। M. Sc. পড়তেই হবে। জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। তারপর ইচ্ছে করলে পরীক্ষায় বসতে পারো,বা, নাও পারো, দুটোই এক!
—আমি পরীক্ষা দেবো। পাশও করবো।
বাবা হাসলেন। হাসিটা দেখে আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। মনে হতে লাগলো একটা কিছু উনি এড়িয়ে গেলেন। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। মনে হলো, এতে উত্তীর্ণ হওয়ার নজীর নেই।
বাবাকে আবার প্রণাম করে আমি এগুলাম ইউনিভার্সিটির দিকে। আমায় ভর্তি হতেই হবে।
[To be continued as (পর্ব=০৬১) ]
Be First to Comment