[প্রদীপের সঙ্গে আলাপ=প্রলাপ ]
((((( পর্ব= ০৮২ )))))
********* Direct from the desk of***********
[মনোবিজ্ঞানী, মঞ্চ-মায়াবী P. C. Sorcar Junior ]
{Dr.Prodip Chandra Sorcar, M. Sc., Ph. D. }
সবজান্তা বাঙালি
ছোটবেলার কনটিনিউয়েশনে, ওভারটাইমে বেঁচে থাকাটাই হলো, এই ধেঁড়ে বেলাটা (sorry, I take my words back ! ) আসলে আমি তো একটা non-classy মাদারি। হাড়ে-মজ্জায় অশিক্ষিত। বুদ্ধিজীবী বাঙালি সমাজের কলঙ্ক। তাছাড়া, স্বভাব যায় না ম’লে। আমার বাবাও এরকম ছিলেন। একটু ক্ষমা ঘেণ্ণা করে মানিয়ে নিন। আপনাদের ওই আধুনিক বুলি: “oh sh—t” ; “– ছনে বাঁশ”; এখনও রপ্ত করতে পারিনি। করবো।পারবো। আপনাদের ছোঁয়ার দোয়ায় পারবো।
বাচ্চা-বাচ্চা বোকা জুনিয়র গুলো যখন বয়স্কদের প্রণাম করে, তখন ওই নমস্যরা বলেন, ‘দীর্ঘায়ু হও’। মানে সোজা কথায় ‘তুমি বুড়ো হও’। অথবা আরও ঘুড়িয়ে বলেন,”যাও, তোমার গতি বৃদ্ধাশ্রমে হোক।” সেই জন্যই তো আজকাল আর কেউ প্রণাম-ট্রনাম করে না। ভয়ে!
আমার বাবা বোধহয়, নিজে ‘বুড়ো’ হয়েও, অঙ্কের হিসেব মতো নিজেকে ‘বুড়ো’ হতে দেন নি। সেজন্য মাত্র ৫৮ বছর বয়সেই কেয়ামতের ওয়েটিং লিস্টে নাম লেখাতে চলে যান। নইলে , ওটা একটা যাবার বয়স হলো?
বাবার ডাকনাম ছিল ‘বুড়ো’। ঠাকুমা আদর করে বলতেন “বুইড়্যা”। ওইভাবে বাবাকে সম্বোধন করার অধিকার একমাত্র ঠাকুমার জন্যই যেন বরাদ্দ ছিলো। পেটেন্টেড । দুজনের দেখা হতো, কালেভদ্রে, বছরে এক- আধ দিন। বাবা সব সময়ে বাইরে বাইরে ঘুরে, ভারতের নিজস্ব ‘মঞ্চমায়া’ যে বিশ্বশ্রেষ্ঠ, সেটা প্রমাণ করবার জন্য দেশী- বিদেশী প্রতিবন্দ্ধকতার সঙ্গে লড়তে ব্যাস্ত থাকতেন।
এই লড়াইটা বাবা কারুর আদেশে বা কাউকে তোয়াজ করার জন্য করতেন না। করতেন অন্তরের তাগিদে । দেশবাসীরা তা বুঝতেন না, এখনও বোঝেন না। বলেন, শুধু শুধু সুস্থ শরীরকে ব্যাস্ত করা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। কে বলেছিলো দেশের সুনাম বাড়াতে? বেশ তো সুখেই আছি । বিদেশীদের চামচা গিরি, বা নিজের দেশের দীনতাকে ‘ ভারতবর্ষের আসল চেহারা’ বলে মেলে ধরলেই চলতো। ভারতের ম্যাজিককে মাদারিদের ওই লেভেলে রেখে দিলেই সত্যি কথা হতো। বিদেশের প্রাইজ ওরা বুল ডোজারে করে ঠেসে ভরে দিতো। বাবা মানেন নি। বলতেন,” ভারতীয়ত্ব শুধু দারিদ্র প্রদর্শনীতে নয়, রাজা, মহারাজা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, সঙ্গীত, কাব্য, সাহিত্য, বিজ্ঞান, জাদুবিদ্যা, সার্কাস, রূপকথার…চৌষট্টি কলা কে ছাপিয়ে, আতিথেয়তা, আন্তরিকতা,দর্শন আরও অনেক কিছু দিয়েও প্রকাশ করা চলতে পারে।” এটাই বাবার অবদান এবং অহংকার। এক্ষেত্রে বাবার ‘অহম্’টা নিছক আত্মকেন্দ্রিক নয়, পুরো
‘সোহহম’। সেজন্য, বাবাকে দেখতাম, ঠাকুমার ওই ডাক শুনে, তাঁর ওই রাশভারী চেহারাটাও কেমন ছেলে-মানুষের মতো হয়ে যেতেন। মানাতো না। বুঝতাম বাবাও একটা ছেলেমানুষ। ঠাকুমা, যেন দেশ মাতৃকা। সমাজ স্বীকৃতি না দিলেও, ঠাকুমা যে পরম স্নেহ ভরে তাঁর এই “বিদ্রোহী রণক্লান্ত” ব্যাতিক্রমী পুত্রের, কপালের ঘামটা মুখিয়ে দিতেন, তখন তাঁর মধ্যে তূতীয় আর একটা বাবাকে খুজে পেতাম। তৃপ্ত বাবা। আমার মা তাঁর সলজ্জ মুখটা দেখতাম লুকোতেন। মুখ ঘুড়িয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছতেন বা মুখে চাপা দিয়ে নিঃশব্দে ফুঁপোতেন। পরে নকল হাসি হেসে ম্যানেজ করতেন। আমরাও পাজী ছিলাম । বলতাম, “এ – মা, এ -মা, ‘মা’ নাকি বুড়ি ! লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছে। হাসছে আবার কাঁদছে।”
মনে আছে, ছোটবেলায় একটা বই-এ পড়েছিলাম, আকাশে যখন বিদ্যুৎ-ঝলক দেয়, তখন তার তিনটে ‘দ’এর মতো চেহারা নেবার কারণ, ঈশ্বর নাকি প্রতিনিয়ত আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনটে ‘দ’এর কথা। দান করো, দয়া করো আর দুষ্টকে দমন করো। গল্পটা ভালো লেগেছিলো। ঠাকুমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “ঈশ্বর কি বাঙালি? যে আকাশে বাংলায় ‘দ’ লেখেন ?”
জবাবে তিনিবলে ছিলেন, “এগুলো সব গল্পকথা। মনে রাখবার জন্য গল্প বানিয়ে বলা। অন্তস্থ শিক্ষা টাই আসল। যিনি বানিয়ে ছিলেন, তিনি বোধহয় বাঙালি বা অসমীয়া। নইলে, অন্যদের ভাষাতেও তো ‘দ’ আছে। তাদের ‘দ’-এর চেহারা আলাদা।…ঠাকুর দেবতার সব গল্পই তাই । আইন গুলো মনে রাখার জন্য, যে যার ভাষায়, গল্প বানিয়ে বুঝিয়েছেন। নইলে সবাই ভুলে যেতো। ”
ঠাকুমা ছিলেন সে যুগের শিক্ষিতা রমণী। ধলেশ্বরী নদীর পাশের গণকপাড়ার প্রখ্যাত ‘ধর’পরিবারের দাপুটে সংসার। ইংরেজদের পুলিশ প্রায়ই সে বাড়িতে কাদের যেন খুঁজতে আসতো। না পেয়ে আবার এসে বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে
যেতো। অসমের ‘মায়ং ‘ নওগা অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু-শিক্ষিত, আয়ুর্বেদাচার্য বংশের মেয়ে। স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে হয়তো উপায় ছিলো না ব’লে জাননি , তবে বাড়িতে বসে বসে কাজের ফাঁকে বিভিন্ন বই পড়ে তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার হয়ে উঠে ছিলো ঈর্ষণীয়ভাবে গভীর। পরবর্তী কালে তাঁর স্বামী, মানে আমাদের ঠাকুর্দা, ভগবান চন্দ্র সরকারের সহযোগিতায়, প্রথম সংখ্যা থেকে আধুনিকতম সংস্করণের প্রবাসী, প্রবর্ত্তক, ভারতবর্ষ, মাসিক মোহাম্মদী, বসুমতী, ইত্যাদি পত্রিকা নিয়ে ডুবে থাকতেন । প্রকাশ্যে ‘চা’ খেতেন। গায়ে ব্লাউজ পরতেন, শাড়ির তলায় সায়াও নাকি পরতেন। এতে নাকি সায় দিতেন আমাদের ঠাকুর্দা এবং দাদা ম’শায়, তার সঙ্গে দিদিমা। দিদিমার ভাই ছিলেন এ. সি. রয়। গ্লাসগো থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রিন্সিপাল। ঠাকুমা, ও যুগের হয়েও, ঠাকুর্দার সঙ্গে মুখোমুখি চেয়ারে বসে “নির্লজ্জ বেহায়ার মতো” একসঙ্গে খেতে বসতেন। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা করতেন। দেখার মতো আলপনা আঁকতেন। নানা যুক্তিযুক্ত আলোচনায় সঙ্গ দিতেন। বিজ্ঞানের আলোচনা না হলেও, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বলতে যা বোঝায়- সবই ছিলো তাঁর জানার জগতে।কোনও মন্তব্য বা আদেশ/ উপদেশ দিলে, বাড়ির সব্বাই সেটাকে নির্দ্বিধায় মানতেন। সন্দেহ বা দ্বিধা থাকলে, পরে দেখতাম, ঠাকুমা ঠিকই বলেছিলেন। আমরাই ছিলাম ভুল। ঠাকুমার পুরো নাম, কুসুম কামিনী সরকার। অনেকে আবার ‘কুসুম কুমারী’ও লিখতেন । সত্যিকারের রত্নগর্ভা। আমার বাবা জাদু সম্রাট পি সি সরকার এবং কাকা, জাদু-রত্নাকর এ সি সরকার, তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
যখনকার কথা বলছি, তখন আমরা সবে পাকতে শুরু করেছি। ঠাকুমা বুদ্ধিমতী হলেও,জড় বিজ্ঞানের খবর তিনি কতোটুকুই বা রাখতেন ! সেজন্য জড়-বিজ্ঞান বা ভৌত বিজ্ঞান সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন তাঁকে করতাম না। উনি কিছু বললে সেটাকে সশ্রদ্ধভাবে পাশ কাটিয়ে যেতাম। সাহিত্য, শিল্প, আচার-ব্যবহার, ধর্ম এক রকম জিনিস, কিন্তু বিজ্ঞান জিনিসটাই একদম আলাদা । কোনও আবেগ, ইমোশন, কম্প্রোমাইজ নেই। বিশেষ করে তখন, যখন আমি বিজ্ঞানের সামান্য এটা-ওটা হাফ পড়ে, সিকি বুঝে, ফুল পণ্ডিতের মতো হাবভাব রপ্ত করতে চলেছি, তখন। সবাই আমরা আইন না বুঝেই এক-একজন আইনস্টাইন।
মনে আছে, সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো। ফলে সন্দ্ধেটা গুটি গুটি পায়ে নয়, বেশ চটপট এগিয়ে এসে, বিকেলকে ছাতা মাথায় ছুটি দিয়েছিলো। বাইরে তখন বেশ অন্ধকার জমেছে।জোরে হাওয়া বইছে। তার শো–শো আওয়াজ টার মধ্যে হঠাৎ করে জোড়ালো আলোর ঝলক দেখেই বুঝি, এ যাত্রায় বেঁচে গেছি, তাই ঝলকটা দেখতে পেয়েছি; এবার ভয়টা পাবার পালা। হাড় কাঁপানো কড়-কড়-কড়াৎ করে কান ফাটানো আওয়াজ। আলো আগে আসে, আওয়াজ তার অনেক পরে। মনে হচ্ছে, কাছে পিঠে কোথাও বাজ পড়লো। স্বীকার করছি, বেশ ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু বীরপুরুষদের তা প্রকাশ করতে নেই। করিনি।
পণ্ডিতের মতো বলি, “খাটের ওপর বসলে ভয়ের কিছু নেই।” নিজের যুক্তি খাটিয়ে, আসলে নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিতে বলে ছিলাম, “খাটে বসে থাকলে বাজ আমাদের মধ্য দিয়ে ‘আর্থ’ পাবার পথ পাবে না। সুতরাং খাটের তলায় না গিয়ে, কাঠের তৈরি খাটের বসে থাকা, যুক্তিযুক্ত ভাবেই নিরাপদ। ” আমি, দাদা, ছোট দি, ঠাকুমাকে নিয়ে খাটে উঠে বসি।
বজ্রপাতের সঙ্গে মোকাবিলায় কী কী অবশ্য কর্তব্য তা নিয়ে সাহসের সঙ্গে আলোচনা করি। ছাদে একটা লোহার এরিয়্যাল লাগানো উচিত। তার সঙ্গে থাকবে আর্থের কানেকশন। ছাদে ফণীমনসা গাছ রাখা চলবে না। বাড়ির কাজের লোকটা বলেছিলো, ফণীমনসা গাছ নাকি বজ্র-বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করে। ছোটদি বলেছিল “কাল সকালেই গাছটা দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসবো।”
আমার তখনকার কাঁচা বিজ্ঞান-মনস্ক চিন্তা কিন্তু তাতে ইনফ্লুয়েন্সড্ হয়নি। তখন ঠাকুমা বলেন, “ওই টুকু একটা কাটা গাছ- ওর জন্য বিদ্যুৎ আসবে কেন? বড় গাছের সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু ওই ছোট্ট ক্যাকটাসে কী হবে? আমার বিজ্ঞান মনস্ক মন একথা সমর্থন করে। ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করি, ” কখনও খুব কাছ থেকে বাজ পড়তে দেখেছেন?
ঠাকুমাকে আমরা সবাই, আমার মা’র দেখাদেখি “আপনি” বলেই সম্বোধন করতাম। মনে আছে ঠাকুমা বলেছিলেন, “হ্যাঁ দেখেছি। আমি তখন খুব ছোট। শিমুলিয়া গ্রামের স্কুল বাড়িতে বাজ পড়েছিল। ”
ছোট দি জিজ্ঞেস করে, “কেমন দেখতে? ”
ঠাকুমা চোখ বড়ো বড়ো করে, অতীতের সেই স্মৃতির ধূলো পড়া পৃষ্ঠা মুছে উল্টে উল্টে চলে গিয়ে বলেন, “সেদিনও এমন ঝড়-বাদল চলছিলো। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে, আর তার সঙ্গে বাজ। আমরা সবাই মাদুরে জড়ো সড়ো হয়ে বসে আছি। এমন সময় হঠাৎ চারদিক আলো হয়ে গেলো আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে সেই বিকট জোরালো শব্দ! কী জোর-কড়-কড়-কড়ড়াৎ কান ফাটানো সেই আওয়াজ। আমরা তো চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছি। চোখ বন্ধ করে সবাই-সবাইকে জরিয়ে চিল-চিৎকার করে কাঁদছি। একটু পরে চোখ খুলতেই দেখি খুব উজ্জ্বল হলদে রঙের একটা বল, তার গা থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে… সেটা আমাদের ক্লাসরুমের ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন বেড়িয়ে যাবার পথ খু্ঁজছে। আমরা ভয়ে চিৎকার করছি তো করছি। সেই আগুণের গোলা, আপন মনে এদিক ওদিক উড়ে, দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যায় পাশের ঘরে—আর তারপর সেই ঘরের জানালা দিয়ে, বাইরে… ।”
সবাই চমৎকৃত হলেও আমি কিন্তু প্রতিবাদ করি। দাদাও ছিলেন সঙ্গে। তিনিও প্রতিবাদ করেন।
“অ্যাঃ , কী বললেন? ‘বল’ ?!? –এ মা, ঠাকুমা মিথ্যে কথা বলছেন। বজ্রপাত নাকি বলের মতো… ঠাকুমার স্কুল ঘরে ঢুকে–পাক খাচ্ছিলো–আর তারপর নিজের মর্জি মতো উড়ে বেড়িয়ে যায়।. ….হতেই পারে না।…..বিদ্যুৎ কখনও বলের মতো হয় নাকি?…..ঠাকুমা মিথ্যে কথা বলছেন… এ মা মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা… ।”
ঠাকুমা কে অতো দিশেহারা হতে আমি কখনও দেখিনি। তিনি আমাদের সামলাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু পেরে ওঠেন না। আমরা তখন সবে বিজ্ঞানের প্রথম আলোতে অজ্ঞান ছেড়ে সজ্ঞান হয়েছি। ঠাকুমা কে টিটকিরি মারতে শুরু করি।
তাঁর সেই অসহায় মুখটা আমার এখনও মনে আছে। বলেছিলেন-” আমি মিথ্যে কথা বলবো কেন? তাতে আমার লাভ কি? যা দেখেছি তাই-ই বলছি। তোমরা আমায় মিথ্যেবাদী ভাবছো?…” বলেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ছিলেন।
আমরা সংযত হলেও ঠাকুমার প্রতি অবিশ্বাস কমেনি। মনে হচ্ছিলো এটা আমাদের বাড়ির ঠাকুমার ঝুলির এক ব্যক্তিগত সংস্করণ। কথাটা ধামা চাপা পড়ে যায়। অন্য কথা এবং কাজের প্রলেপে ও কথা আর ওঠেনি।
তারপর কততো বছর কেটে গেছে। ঠাকুমা এখন নেই। বাবাও নেই। দাদা অ্যামেরিকায় বিরাট ইন্জিনিয়ার । আমি পুরোদমে ম্যাজিক শুরু করে দিয়েছি। কেরালাতে টানা এক বছর ধরে শো করছি। তখনকার কথা। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি, 2000 খ্রিস্টাব্দ। চেন্নাই থেকে প্রকাশিত ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার শেষ পাতায়, ‘আউট অফ দা অরডিনারি’ নামে একটা নতুন আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। নতুন আবিষ্কার। পড়ে আমার ভেতরে একটা তোলপাড় শুরু হলো। এ কী পড়ছি?
লেখা আছে, বজ্রপাতের পর মাঝে মাঝে অদ্ভুত দর্শন উজ্জ্বল ‘বল’কে হাওয়ায় ভাসতে দেখা যায়। বেশ কয়েক সেকেণ্ড সেই বল হাওয়ায় ভেসে এদিক ওদিক উড়ে নিঃশব্দে অথবা ‘পপ্’ করে ছোট্ট একটা আওয়াজ করে ফেটে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওর রং উজ্জ্বল হলুদ বা সাদা হতে পারে। সাইজ একটা বেদানা ফলের মতো। বাড়িতে ঢুকে এ ঘর- ও ঘর উড়ে বেড়ানোর সংবাদ পাওয়া গেছে। এমন কি, উড়ন্ত অ্যারোপ্লেনেও মাঝে মাঝে এ আবির্ভূত হয়ে সবাইকে ঘাবড়ে দিয়েছে। এতদিন ধরে এর কারণ বৈজ্ঞানিক দের জানা ছিলো না। কিন্তু সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের দুজন বৈজ্ঞানিক John Abrahamson এবং James Dinnis ,এর রহস্য উন্মোচন করেছেন। ওঁরা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, যখন বজ্রপাত হয়, তখন সেই বিদ্যুৎ মাটি ভেদ করে ভেতরে গেলে, তার সৃষ্ট প্রচণ্ড উত্তাপে মাটির সিলিকন কারবন থেকে সিলিকন পার্টিকেল তৈরি হয়। সেই সিলিকন পার্টিকেল পরস্পর জোড়া লেগে, যেন হাত ধরাধরি করে হাওয়ায় ভেসে উঠলে, নিঃশব্দে পুড়তে থাকে। হাওয়া তাকে এদিক ওদিক উড়িয়ে নিয়ে যায়। সবার পর, পোড়া শেষ হলে ও অদৃশ্য হয়ে যায়। পরীক্ষাগারে ওভাবে বজ্রপাত তৈরি করে সিলিকনে আগুণ ধরানো না গেলেও, বৈজ্ঞানিক সমাজ এই অবাক করা ‘বল’ -এর আবির্ভাবের ঘটনা এবং কারণকে ‘সত্য’ বলে মেনে নিয়েছেন।
লেখাটা পড়ে আমি স্তম্ভিত। আজ বহুদিন পর আবার ঠাকুমার সেই অসহায় মুখটা আমার চোখে ভেসে উঠলো। আমাদের টিটকিরিতে কষ্ট পেয়ে শাড়ীর খুটি দিয়ে চোখ মুছে বলছেন–” আমি মিথ্যে কথা বলবো কেন? মিথ্যে কথা বলে আমার লাভ কী? ”
সত্যিই ঠাকুমা, আপনি মিথ্যে বলেন নি। এতদিন আমি না জেনে ‘মিথ্যে কথা’ বলে ভেবেছিলাম। ভুলের জগতে আমি বাস করছিলাম। আপনি এখন কোথায় জানি না। আমাকে দেখতে, শুনতে পাচ্ছেন কিনা তাও জানিনা। কিন্তু সেদিন অল্পবিদ্যার অহংকারে আপনাকে যে কষ্ট দিয়েছিলাম, সেজন্য আমি খুবই দুঃখিত। ক্ষমা প্রার্থী। বুক আমার ফেটে যাচ্ছে। দুঃখ লজ্জার সীমা পেরিয়ে মনের মধ্যে অনেক গভীর বেদনার খাদ – ক্রেটর তৈরি করেছে। এই ক্ষত শুকোবার নয়, যদি না, আপনি দয়া করে আমার অজ্ঞতা, নীচতা, ক্রুরতা ক্ষমা করেন। এরকম ভুল, আমি হয়তো আরও করেছি। করে চলেছি। ভয় লাগছে। দীন আমি, হীন আমি, স্বল্প-বুদ্ধির আমি, কিন্তু সৎ আমি। তাই সরল মনে, আমি চারদিকের সবার কছে , না জেনে ভুল করে থাকলে, ক্ষমা চাইছি।
ঠাকুমার এই ছবিটা কাকতালীয়ভাবে বিনা ক্লেশেই, এক দম হাতের কাছে, ড্রয়ারে পেলাম। চমকে উঠলাম। প্রণাম করলাম। ঠাকুমা আমায় ক্ষমা করেছেন বলেই ভেবে নিয়েছি। ভেবেই শান্তি…তাই না? জয় হিন্দ ।
Be First to Comment