স্মরণ : জীবনানন্দ দাশ
“তারপর মৃত্যু তাই চাহিলাম– মৃত্যু ভালো– মৃত্যু তাই আর একবার/ বিবর্ণ বিস্তৃত পাখা মেলে দিয়ে মাঝ-শূন্যে আমি ক্ষিপ্র শকুনের মতো/ উড়িতেছি–উড়িতেছি; ছুটি নয়–খেলা নয়–স্বপ্ন নয়–যেইখানে জলের আঁধার /বৈতরণী–বৈতরণী– শান্তি দেয়–শান্তি–শান্তি–ঘুম–ঘুম–ঘুম অবিরত/ তারি দিকে ছুটিতেছি আমি ক্লান্ত শকুনের মতো।” ----------- জীবনানন্দ দাশ
বাবলু ভট্টাচার্য : মৃত্যুকে এভাবেই শান্তির ঘুম বলে মহাকাব্যের দেহ-মন নিয়ে উড়ে গেছেন নক্ষত্র শোভিত শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ। আজকের দিনে এই শুদ্ধতম কবি এভাবেই শান্তির খোঁজে চলে গেছেন মহাকালের ছায়া পথ ধরে। রেখে গেছেন জীবনের অফুরান বোধ আর্শীবাদ স্বরূপ।বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের বলয় ভেঙে এক নতুন উপখ্যান নিয়ে সাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উদিত হন জীবনানন্দ দাশ। প্রচারবিমুখ নিভৃতচারী এই মানুষটি বরাবরই প্রকৃতির ভিতর ডুব দিয়ে নিঃশব্দে তুলে এনেছেন অনন্য সব রত্ন। বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারকে শুধু সমৃদ্ধই করেননি সেই সাথে দেখিয়েছেন আধুনিক কবিতার পথ। বাংলা সাহিত্যের এক অমর অধ্যায়ের সুচনা হয়েছিল কবি জীবনানন্দ থেকে।
মৃত্যুর পর তাঁর অনেক অপ্রকাশিত কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। সময়ের সাথে সাথে বাংলা সাহিত্যে এই কবির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ সালে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন— যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি।জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মাতা কুসুম কুমারী দাশও একজন সুপরিচিত কবি ছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কিছুদিন আইন বিষয়েও পড়েন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন ছেড়ে দেন। এরপর ১৯৩৫ সালে তিনি বরিশাল বিএম কলেজে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। ফিরে আসেন বরিশালে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ সালে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তাঁর স্মরণে ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ নামে একটি কবিতা লেখেন— যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এ বছরই প্রবন্ধসহ আরো কয়েকটি লেখা প্রকাশ হয় বিভিন্ন পত্রিকায়। এর মাঝে কল্লোল পত্রিকায় ‘নীলিমা’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে তা অনেক তরুণ কাব্যসরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে; যার মধ্যে রয়েছে সে সময়কার সুবিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতি প্রভৃতি।১৯২৭ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি তার উপাধি ‘দাশগুপ্ত’-এর বদলে শুধুমাত্র ‘দাশ’ লিখতে শুরু করেন। মূলত বরিশাল শহরে ফিরে গিয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি কবি তার কাব্য পরিচয়কে মেলে ধরেন। এখানে বসেই লেখেন তার বিখ্যাত অনেক কবিতা। এ পর্যন্ত তার মোট ১৩টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে জীবদ্দশায় ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন মৃত্যুর পর। তিনি বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার পথিকৃতদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন মৃত্যুর পরে।
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলার আত্মমগ্ন কবি কলকাতার পথ ধরে হেঁটে চলছিলেন। তখন একটি ট্রামের ধাক্কায় আহত হন। এরপর তাকে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৪ সালের আজকের দিনে (২২ অক্টো) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment