—————-স্মরণ : উৎপল দত্ত—————-
বাবলু ভট্টাচার্য : বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধ জুড়ে বাংলা থিয়েটারের যে বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে, তার অগ্রণী স্থপতিদের মধ্যে উৎপল দত্তের স্থান খুবই উঁচুতে। এ নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। তিনি যে এক জন যুগস্রষ্টা নাট্যপরিচালক ছিলেন এবং ছিলেন একজন পরাক্রান্ত অভিনেতা, এ কথাও সর্বজনমান্য বলেই মনে হয়। উৎপল দত্ত রেখে গেছেন সৃষ্টির বিপুল বৈভব। বহুকৌণিক ছিল তাঁর সৃজনীপ্রতিভা। নাটক লেখা ও প্রযোজনা ছাড়াও নাটকের দল তৈরি ও তাকে চলমান রাখার কাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। লিখেছেন ও প্রযোজনা করেছেন বহু অতীব জনপ্রিয় যাত্রাপালা। অসংখ্য পথ-নাটিকার মধ্যে রয়ে গেছে তাঁর দীপ্ত মনীষার ছোঁয়া। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই অনর্গল রচনা করেছেন কালজয়ী সব নাট্যনিবন্ধ। রচনা করেছেন নাট্যগ্রন্থ। লিখেছেন কবিতা। প্রদান করেছেন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেশে ও বিদেশে।
অভিনয় করেছেন নাট্যমঞ্চের বাইরে বহু স্মরণীয় চলচ্চিত্রে বাংলা ও হিন্দিতে। নির্মাণ করেছেন একাধিক চলচ্চিত্র। নাট্যাচার্যের মতোই তৈরি করেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীর বাহিনী, প্রজন্মের পর প্রজন্মে। চালিয়েছেন নাটমঞ্চ এক দশকেরও বেশি সময় জুড়ে। মতাদর্শগত সংগ্রামের ফলস্বরূপ কারাবরণ করেছেন এমনকি। এত বিশাল এবং একই সঙ্গে এত বিচিত্র, জটিল, বহুবর্ণ চরিত্র দুশো বছরের বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইংরেজ নাট্যব্যক্তিত্ব জেফ্রি কেন্ডালের পেশাদার নাট্যশালায় দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে পরবর্তী জীবনের পেশাদার নাট্যকর্মী উৎপলের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ। এর পর লিটল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা উৎপল দত্তের গোত্রান্তর ঘটে। মার্ক্সবাদী জীবনবীক্ষায় তাঁর আস্থা দৃঢ়তর হতে থাকে।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ছত্রছায়ায় থিয়েটার করার স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতার পরে তিনি ফিরে আসেন নিজের দলের সৃজনী-বৃত্তে। কিন্তু ‘জনতার মুখরিত সখ্য’ থেকে আর দূরে থাকেননি কখনও। ইংরেজি পেশাদার থিয়েটারের কঠোর শৃঙ্খলার সঙ্গে এ বার যোগ হয় রাজনৈতিক থিয়েটার গড়ে তোলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। পথ-নাটকের সৃষ্টি ও প্রযোজনার সঙ্গে সঙ্গে পেশাদারি ভিত্তিতে মিনার্ভা রঙ্গালয় চালানোর দুরূহ নিরীক্ষায় নিযুক্ত হন উৎপল ও তাঁর দল এলটিজি। ততদিনে সত্তর দশকের উত্তাল সময় এসে পড়েছে। নকশালপন্থী রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ থেকে তৈরি নাটক ‘তীর’ উৎপলকে সংকটের সীমায় নিয়ে যায়। বামপন্থার মূল ধারার সঙ্গে সংঘাত ও দ্বন্দ্বের কারণে মিনার্ভা থিয়েটার ছাড়তে হয় উৎপলকে। উপর্যুপরি গ্রেফতার, কারাবাস ও রাজনৈতিক তৎপরতায় উৎপলের জীবন এই সময়-পর্বে বিক্ষুব্ধ, টালমাটাল। এর পর অক্লান্ত উৎপল গড়ে তোলেন নতুন নাট্যসংস্থা ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’।
এক আধুনিকতর নাট্য-ব্যক্তিত্বের অভ্যুদয় লক্ষ করি আমরা। রাজনৈতিক যাত্রাপালা রচনা ও প্রযোজনায় নতুন ঘরানা সৃষ্টি করেন এই পর্বেই। চলচ্চিত্রের অনন্য অভিনেতা হিসেবেও এই দ্বিতীয় পর্বে উৎপলের প্রতিষ্ঠালাভ ঘটে। আশির দশকের শেষ দিক থেকেই অসুস্থ হতে শুরু করেন তিনি।
উৎপল দত্ত ১৯৯৩ সালের আজকের দিনে (১৯ আগস্ট) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment