ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : ১৫ নভেম্বর, ২০২১। ক্ষিতি, অপ , তেজ , মরুৎ , ব্যোম এই পাঁচ শক্তির নিয়ন্তা শিব যখন চৈতন্যশক্তি পার্বতীর সঙ্গে মিলিত হন তখন সৃষ্টি হয় ” কার্তিকের “৷ পুরাণে অনেক গল্প আছে তেমনই একটি কাহিনী সতীর মৃত্যুর পর কঠোর তপস্যারত শিবকে আবার স্বাভাবিক করতে দেবতারা ফন্দি করে মহামায়ার ছায়া দিয়ে পার্বতীকে সৃষ্টি করেন ৷ পার্বতীর সঙ্গে সহবাসে শিবের রেতঃস্খলন হচ্ছে না দেখে অগ্নিদেব হাঁস হয়ে শিবের আবেশ ভাঙালে শিবের রেত হাঁসরূপী অগ্নির ঠোঁটে স্থাপিত হয় ৷ কিন্তু অগ্নি সেই তেজ ধারণে অক্ষম হয়ে তা আকাশগঙ্গায় নিক্ষেপ করেন ৷ গঙ্গাও বইতে বইতে তা শরবনে দিয়ে পুড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচেন ৷
এই শরবণেই জন্ম হয় শিশু ষড়ানন বা কার্তিকের ৷ ছয় জন কৃত্তিকা তাঁর ছয় মুখে স্তন্যপান করিয়ে বড় করেন৷ তাই , কার্তিক হলেন ষড়ানন ! যিনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনকে নিয়ন্ত্রন করেন৷ জন্মের পর ছয় জনকৃত্তিকা তাঁর ছয় মুখে স্তন্যদান করেছিলেন ৷ এজন্য ষড়ানন নামটি খ্যাতি অর্জন করে ৷ ষড়াননের ৬ টি গুণ হলো – জ্ঞান, বৈরাগ্য , শক্তি , কীর্তি, শ্রী ও ঐশ্চর্য ৷ তিনি আমাদের ষড়রিপু –
কাম, ক্রোধ , লোভ, মোহ , মদ ও মাৎসর্যকে দমন করেন ৷ তিনি আমাদের দেন স্ব উপলব্ধির ক্ষমতা ৷ কার্তিকের সঙ্গে ছয় সংখ্যাটি ওতোপ্রোত ভাবে যুক্ত ৷ তাঁর ছয় মাথা অর্থাৎ তিনি ষড়ানন ৷ ছয় জন কৃত্তিকার স্তন্যপান করে তাঁর বড় হওয়া ৷ মাত্র ছ’দিন বয়সে তারকাসুরকে বধ করা৷ আবার মহাভারত অনুসারে ইন্দ্রের মেয়ে ( যদিও কারো মতে ব্রহ্মার মেয়ে ) দেবসেনা বা ষষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ ৷পুরাণ মতে তিনি মানুষের যুক্তি , আবেগ , জ্ঞান , চিন্তা , বুদ্ধি ও সচেতনতাকে নিয়ন্ত্রণ করেন ৷ এদের শত্রু কাম , ক্রোধ , লোভ , মদ , মোহ ও মাৎসর্য এই ছয় রিপুর সঙ্গে মানব চেতনার যুদ্ধের প্রতীকী দেবতা হলেন কার্তিক ৷ যিনি ইন্দ্রকে পরাজিত করেও স্বর্গের রাজ্যপাট না নিয়ে স্বেচ্ছায় সেনাপতি পদ গ্রহন করেছিলেন ৷ স্কন্দ, মুরুগন , অগ্নিক , কুমার ,শরজ,তারকারি , শক্তিপাণি , সারস্বত, বিশাখ ,ষড়ানন, মায়ূরী কন্দসাসী ,গূহ,ক্রৌঞ্চারতি, সুব্রহ্মনিয়ম ইত্যাদি নামে পূজিত হন ৷” মুরুকা” –
মু মানে মুকুন্দ বা বিষ্ণু , “রু” – অর্থাৎ রুদ্র রা শিব ৷
“কা” – মানে কমল ব্রহ্মা ৷ সুতরাং , তিনি সৃষ্টি , স্থিতি ও সংহার কর্তা ৷ তামিলনাড়ুতে কার্তিক ভক্তদের জিভ, গাল ফুটিয়ে , শিকল বেঁধে নানা কৃচ্ছ্রসাধন দেখে অবাক হয়েছি ৷ বাংলায় নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তান কামনায় দেবসেনাপতির মত পুত্র কামনায় এই পুজো করেন ৷ অনেক জায়গায় ছেলে হবে বলে নিঃসম্তান দম্পতির গৃহে মজা করে অনেকে কার্তিক ঠাকুর ফেলে আসে ৷ সেই গৃহে ধূম করে তা পূজিত হয় ৷ ৷দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ও বীর ” কার্তিক” ৷তিনি তারকাসুরকে শৈশবেই বধ করেন ৷
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে কামদেব কামশাস্ত্রের জ্ঞান দিয়েছিলেন ৷ এছাড়া সুরপদ্ম, ক্রৌঞ্চ দৈত্যকে মেরেছিলেন ৷ধর্মের রক্ষাকারী ও মানবকল্যাণকারী কার্তিক সুরপদ্মকে দ্বিখন্ডিত করলে একটা অংশ ময়ূরে পরিণত হয় ৷ যা হয় তাঁর বাহন ৷অন্য অংশকে ধ্বজা করেন ৷গীতায় কার্তিককে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অভেদ বলা হয়েছে ৷ ” সেনানীনা মহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগরঃ “! কালিদাসের “কুমার সম্ভব” কাব্যে কার্তিকের জন্মের বিবরণ আছে ৷ শুদ্রকের “মৃচ্ছকটিক ” নাটকে আবার চোরদের পূজিত দেবতা বলা হয়েছে ৷ চোর শাস্ত্রকে তাই বলা হয় “ষন্মুখকল্প ” ৷আবার কার্তিককে উর্বরা শক্তির প্রতীক রূপেও দেখা হয়েছে ৷সেক্ষেত্রে কার্তিক হলেন সন্তানের রক্ষাকত্রী মা ষষ্ঠীর স্বামী ৷ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পড়ে বোঝা যায় সে সময়ে কার্তিক ঠাকুরের জনপ্রিয়তা ৷ যা কুষাণ যুগ পর্যন্ত ছিল ৷”মুরসংহারম” বা স্কন্দষষ্ঠী তামিলনাড়ুতে ৬ দিন ধরে পালিত হয় ৷ওড়িশায় বিজয়া দশমীর পর কার্তিকের মত সুদর্শন ও গুণী স্বামী পাওয়ার জন্য কুমার পূর্ণিমা ব্রত করেন ৷কার্তিক যেমন সারা দেশে নিঃসন্তান দম্পতির আরাধ্য ৷ তেমনই দেহ বিক্রি করলেও একটি মেয়ের চাহিদা থাকে সুপুরুষ , সাহসী ও বলশালী স্বামীর ৷ সেই না পাওয়া থেকে হয়ত গণিকাদের মধ্যেও এই পুজো প্রচলিত হয়েছিল ৷যেসব মায়েদের গর্ভের ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যেত তাঁরা কার্তিকের পুজো করত ৷আবার সন্তানের মঙ্গল কামনায় করত কার্তিক পত্নী ষষ্ঠীর পুজো ৷ হিন্দু বিশ্বাস শুদ্ধাসনে বসে একনিষ্ঠ ভক্তিভাবে কার্তিকের বীজমন্ত্র “ওঁ কাং ওঁ” ১০৮ বার জপ করলে সুসন্তান লাভ ও ভাগ্যদয় হয় ৷ শত্রু দূর হয় ৷ তামিলনাড়ুর প্রধান দেবতা কার্তিক। “মুরুগন” মানে ময়ূরবাহন ৷ স্কন্দ/ কার্তিকেয় /মুরুগনের ৬ টি পুণ্যতীর্থই ঐ রাজ্যে ৷
সেগুলি হলো – তিরুতানি , স্বামীমালাই , পালানি ,
পাজামুদিরচোলাই , তিরুপারনকুনরাম ও তিরুচেন্দুর ৷ এই ছয় জায়গায় কার্তিক ৬ টি অস্ত্রাগার (তিরুমুরুগাতরুপাদাই) স্থাপন করেছিলেন বলে সুপ্রাচীন তামিল সঙ্গম সাহিত্যে বলা হয়েছে ৷
বাঙালী তথা উত্তর ভারতীয়দের কাছে “কার্তিক” চিরকুমার হলেও দক্ষিণ ভারতীয় মনে করেন তাঁর দুই স্ত্রী ৷ এই মূর্তিকে “ত্রয়ী মূর্তি” বলে ৷ তাঁর প্রথম স্ত্রী দেবসেনা -ইচ্ছাশক্তি ও দ্বিতীয় স্ত্রী বল্লি ( কৃষ্ণ বর্ণা , দক্ষিণ ভারতের এক উপজাতি রাজার মেয়ে )- ক্রিয়া শক্তির প্রতীক ৷ শরবনে ৬ টি মাথা নিয়ে কার্তিকের জন্ম। ছ’জন কৃত্তিকার দ্বারা পালিত বলে নাম “কার্তিক”। তাঁর নামে একটি মাসের নাম ৷ কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে হয় তাঁর পুজো ৷
শিব কার্তিককে দিয়েছিলেন দেবসেনাপতির পদ ৷ গরুড় দিয়েছিলেন বাহন “ময়ূর “৷ সাপ ভক্ষক ময়ূরের মধ্যে কোন অলসতা নেই ৷ কার্তিকের ছয় মাথা হলো – এষনম, সৎপুরুষম, বামদেবম, অঘোরম , সত্যজাতম ও অধরমুগম ৷ শিবকে মুরুগন বা কার্তিক বলেছিলেন বিশ্বব্রহ্মান্ড যে অকৃত্রিম প্রেম থেকে হয়েছে তাই “ওম্” ! আধ্যাত্ম তত্ব বলে , ” কুলকুন্ডলিনী শক্তি উদ্ধর্গামী হয়ে যখন আজ্ঞাচক্র ভেদ করে তখন কার্তিকের আর্বিভাব হয় ! কার্ত্তিকেয়য়র গায়ত্রী ,” ওঁ কাং কার্ত্তিকেয়ার বিদ্মহে দৈত্যদর্পনিসূদনায় ধীমহি তন্নো গৌরীপুত্র প্রচোদয়াৎ ৷” আমরা ধ্যান করি ,” ওঁ কার্ত্তিকেয়ং মহাভাগং ময়ূরোপারিসংস্থিতম্ ৷/ তপ্ত কাঞ্চনবর্ণাভং শক্তিহস্তং বরপ্রদম্ ৷/ দ্বিভুজং শত্রুহন্তারং নানালঙ্কারভূষিতম্ ৷ / প্রসন্নবদনং দেবং সর্ব্বসেনা সমাবৃতম্ “৷ দেবসেনাপতিকে প্রণাম জানাই ,” ওঁ কার্ত্তিকেয় নমস্তুভ্যং গৌরীপুত্রং সূতপ্রদম্ ৷/ ষড়াননং মহাভাগং দৈত্য দর্পনিসূদনম্ “৷৷ জয় কার্ত্তিকেয় ৷
Be First to Comment