[প্রদীপের সঙ্গে আলাপ=প্রলাপ]
(পর্ব—০৪৯)
মঞ্চ মায়াবী, জাদুশিল্পী পি সি সরকার, জুনিয়র
(Dr. Prodip Chandra Sorcar M.Sc., Ph.D.)
কলকাতা, ১, মার্চ, ২০২১। বসুধৈব কুটম্ বক্ বকম্। রাশিয়াতে আমি যখন প্রথমবার, 'ভারতের মঞ্চমায়া' " ইন্দ্রজাল" প্রোগ্রাম নিয়ে ওদের সামনে সদলবলে গর্বের সঙ্গে মেলে ধরি, তখন তাঁরাও আমাদের কাছে, তাঁদের গর্বের প্রদর্শণীগুলো, ঠিক সমান শ্রদ্ধা এবং অহঙ্কারের সঙ্গে মেলে ধরেন। ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লেগেছিলো। ওঁদের ওই 'নিজেকে দেখানো'র প্রবণতা, প্রতিদ্বন্দীতা এবং তার গুণ-গত-মান দেখে আমি আমার নিজের একটা মূল্যায়ন করতে পেরেছিলাম। তবে হ্যাঁ, আমি ইন্দ্রজাল দেখিয়ে, ওঁদের কতোটা গভীর ভাবে মুগ্ধ করতে পেরেছি, তা আমি জানিনা, কিন্তু আমি যে ওঁদের শিল্প-সমঝদারিতে অন্ততঃপক্ষে সেয়ানে-সেয়ানে, সেটা ওদের ওই, শুধু একদম সেরা সম্পদগুলোকেই মেলে ধরার প্রবণতা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম। আমাকে এঁরা 'রতনে রতন চেনে' ফরমূলায় ফেলে , সম্মানিত করেছেন। আমি নিজেকে ধন্য বোধ করছি।
রাশিয়ার জনগণ জাদুবিদ্যাকে বিজ্ঞান, জনগণ- মনোবিজ্ঞান এবং নাটকীয়তার এক উঁচু শ্রেণীর মিশ্রণের আর্ট বলে গণ্য করেন এবং সরকারি-ভাবেই এর সাধনা-গবেষণায় সমর্থন করেন এবং মানেন। আমাদের দেশের মতো নয়। আমাদের দেশ হচ্ছে -" খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না" ;"বুঝছে কিন্তু ভাবছে না"; "শুনছে কিন্তু কানে ঢুকছে না"-এর মতো অবাক করা একটা দেশ। এখানে আমাদের দেশের গর্ব করার মতো বহু সম্পদ, আর্ট-ওয়ার্ক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে এড়িয়ে, নেতা-নেত্রীরা নিজেদের প্রশংসা নিজেরাই যত্র-তত্র, এখানে-ওখানে -সেখানে লাগান। দেখতে হলে এটা দ্যাখো । ঈশ্বর-আল্লা-গড-এর যেন প্রতিদ্বন্দী । জনগণের ট্যাক্সের টাকাতে জনগণের জন্যই লাগিয়ে থাকেন। এখানে "লজ্জা, ঘেণ্ণা ,ভয়, তিন থাকতে নয়"-এর ফিলোজফি চলছে। বিদেশের কেউ এসে--"ইনি কিনি ?" বা, " এতো কেন!!"- প্রশ্ন তুললে জবাব দিতে পারি না। ফুলিয়ে, ফাঁপিয়ে, হাঁপিয়ে মহামানব-মহামানবী বানিয়ে মিথ্যে প্রশংসা করতে কূল পাই না। ওঁরাও মিথ্যে অবাক হবার ভঙ্গীমা করে বলেন "উনি যে এত বড় শিল্পী, এতো গুণী, আগে জানতাম না। পরবর্তী নোবেল প্রাইজ তাহলে ওনার জন্যই বরাদ্দ রাখা হোক" ।
আমিও আমার ট্রেড মার্ক, বোকার হাসি হেসে বলি, “এখানে ভীষণ নোবেল চোর। উঁচু ক্লাসের নিশীকুটুম্ব । অমর্ত্য সেনের পাওয়া নোবেলের রেপ্লিকাটা এয়ার পোর্টে, কবিগুরুর অরিজিনালটা সংরক্ষণ শালা থেকেই চুরি হয়ে গেছে। তারপর থেকে এই এঁনারা ঠিক করছেন, ” চুরি যখন হবেই, তখন সেটা আর নেওয়া কেন !!?? না পেয়েই নিশ্চিন্ত থাকা যাক।”
তাই নেন না।
খালি হেসে হেসে নিজের ছবি রাস্তায় রাস্তায় লাগান। পাবলিক ও খুব তৃপ্ত। "বিশ্ব মায়া-ময়" আর "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা", বা "শ্রীমৎ ভগবৎ গীতায় বর্ণিত বিভিন্ন বিজ্ঞান-ভিত্তিক 'অলৌকিক' ঘটনার গাল-ভরা সনাতনী 'সত্যি'কথা, 'সশ্রদ্ধ'ভাবে উল্লেখ করা থাকলেও, আমাদের দেশের আইন-তৈরির কর্তা-ব্যক্তিদের কাছে এই ' ম্যাজিক 'আর্টটার পরিচয় হলো 'চিটিং-বাজী'। বেচারা ওই আইন-প্রণেতাকে হয়তো কোনও দক্ষ- জাদুশিল্পী খুব ঠকান ঠকিয়ে ছিলেন! তখন লজ্জায় হয়তো ফুঁশতে ফুশঁতে ,তিনি, "'শোলে" সিনেমার গব্বর সিং এর মতো কসম্ খেয়েছিলেন,"ইসকা সাজা মিলেনা। জরুর মিলেগা !!" তাই কুসংস্কারকে বিজ্ঞানের সঙ্গে গুলিয়ে ম্যাজিশিয়ানদের তিনি সাজা হিসেবে অপমান করলেন। " না জানিলি, না বুঝিনি, এবে এ পরাণ কাঁদে ।"
ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডের , ৪২০, ৪২১ , ৪২২ ইত্যাদি ধারায় ম্যাজিক নাকি , লোক-ঠকানোর অপরাধ-সম এক দুষ্কর্ম !!
ওঁদের কাছে নাটক হচ্ছে ‘সত্যি’, কিন্তু ‘ম্যাজিক’? হেঃ হেঃ , মোটেই সত্যি নয় !
সিনেমাও ‘সত্যি’, সেখানে মানুষের মুণ্ডু-কাটার দৃশ্যটা ফিল্মী- ট্রিক হলেও , মাইরী বলছি, সেটা আর্ট ।
কিন্তু স্টেজে ট্রিক করে ‘মুণ্ডু-কাটা’ দেখালে, সেটা ভালো অভিনয়ে সত্যি বলে মনে হলেও, আর্ট নয়। এ যেন ‘ননী চোর’কে হাতে-নাতে ননী চুরি করতে ধরে জেল-এ পাঠানোর মতো যুক্তি। “ম্যায়নে-হী (ম্যায় নেহী) মাক্খন্ খায়া”-র মতো দ্বর্থক, সত্যি -মিথ্যে কথার,মাথাও নেই মুণ্ডুও নেই , “পাগোল,না মাথা-খারাপ”-এর এক -পেশে বা দুই-পেশে ডিসিশন। সব হাই হাই, হাই তোলার ব্যাপার। ∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆ রাশিয়ার মিউজিয়াম, ঐতিহাসিক ঘটনাস্থল,মহাকাশ বিজ্ঞানের প্রদর্শনী, স্বনামধন্য ব্যক্তিদের কর্মস্থল ইত্যাদি, এতো সুন্দর এবং যত্ন করে রাখা, আর তার বৃত্তান্ত জানানোর জন্য পুস্তিকা এত সুন্দর আর তথ্য সমৃদ্ধ যে আমাদের সঙ্গে তার তুলনা করাটা অনুচিত।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের বাড়ি, তাতে তাঁদের ব্যবহৃত সব কিছু এমন ভাবে সাজানো আছে যে চট্ করে দেখলে মনে হবে তিনি এখনও সেখানে বসবাস করছেন, নেহাত জরুরী কাজে পাশের ঘরে-টরে কোথাও গেছেন। ফিরে আসবেন এক্ষুনি। তাঁরা যেন এখনো আমাদের সঙ্গে আছেন, আমরা নেহাত অসময়ে এসে পড়েছি। খু-ব ভাব গম্ভীর, শ্রদ্ধা জাগানো পরিবেশ। সব কিছুই প্রাণবন্ত, সব কিছুই যেন একান্ত আপন।
আমার বাবা এবং আরোও পূর্ব-পুরুষের জন্য কষ্ট হয়। বাবার মুখে শুনেছি, এবং তাঁর অনেক লেখায়ও পড়েছি, আমরা বংশ পরম্পরায় জাদু চর্চা করছি। পুরো ব্যাপারটা ছিলো গোপন। আমাদের পদবী আসলে ‘দেব’। আমাদের এক বিজ্ঞান-মনস্ক জাদুশিল্পীর হাতের ম্যাজিক দেখে অভাব কাটাতে সূতিপাড়ার জমিদারী/সরকারী দেন জাহাঁপনা জাহাঙ্গীর। সেটা নাকি ছিলো ত্রিপুরায়। তিনি কেমিক্যাল ম্যাজিক শিখেছিলেন আসামের নওগাঁ বাসী শ্বশুড়-বাড়ির দৌলতে।তারপর থেকেই আমরা হই দেব-সরকার। আমার ঠাকুরদা এই দেবত্ব বাদ দিয়ে শুধু সরকার লিখতে শুরু করেন। আমরা যে জাদু-সাধক সেটা নানাবিধ কারণে গোপন রাখা হতো। বাবা করলেন প্রতিবাদ এবং জাদুশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
সেখান থেকে শুরু করলে এই জাদু-ধারা বহমান পরিবারের মধ্যে, বাবা ছিলেন ‘সপ্তম’ পুরুষ এবং আমি হচ্ছি ‘অষ্টম’। মানেকা, মৌবনি আর মুমতাজ, আমার মেয়েরা, হচ্ছে নবম প্রজন্ম।
সম্প্রতি এক খুচরো সবজান্তা পণ্ডিত অনেক বাজে তথ্য দিয়ে ‘পণ্ডিত’ সেজে আমাদের পরিবার নিয়ে অনেক ফালতু কথা লিখেছে। আমাদের পরিবারের খবর আমাদের চেয়েও দেখছি সে বেশি জানে।
“আরে, !! তুই কি তাহলে সেই গ্রামের সিঁধ কাটা ‘হমীর’ নামের চোরটা নাকি? সে নাকি বাইরে থেকে খবর রাখতো বাড়িতে ক’জন লোক আছে, কে কে রাত জেগে পড়াশোনা করে, কখন বাথরুমে যায় ? তারপর কূয়ার বালতীটা চুরি করে নিয়ে পালাতো?লোকে বলতো ওর নাম নাকি ঘুষ-খোর হুমীর । “আয় আয়, কাছে আয়, কানটা একটু মোচড় দিয়্যা টাঙ্গাইলের ধোলাইডা মনে করিয়্যা দেই। ভুইল্যা গেছস্ ?
এখন ইতিহাস লিখতে আইছস্ ? তর মন পরিস্কার কইরতে আমি তরে ডেটল ধোলাই-এর ব্যবস্থা কইরা রাখছি । দ্যাখাইতাছি মজা।” ++++----××××÷÷÷÷÷√√√√
আজ থেকে ঠিক চব্বিশ বছর আগে, যখন আমাদের নিজেদেরই বাড়িটা, ঠিক আমাদের হয়েও, আমাদের ইচ্ছে মতো আমরা টানটান পরিষ্কার রাখতে পারতাম না, বাড়ির চারদিকের পাঁচিল আমরা নিজেরাই গ্যাটের পয়সা দিয়ে বানিয়ে রঙ্ করলেও তার পরিচ্ছন্ন রাখার সুরুচীটা আমাদের মর্জিমতো প্রকাশ করা ছিলো অসম্ভব, সোজা কথায় আজকের মতোই পাড়ার তোলাবাজদের জুলুমের ওপর নির্ভরশীল ছিলো।তখন ওদের নাম ছিলো রং -বাজ । এখন প্রমোশন হয়ে হয়েছে তোলাবাজ । সেই রংবাজ দের জ্বালায় তখন আমাদের বাড়ির দেওয়ালে পরিষ্কার রাখতে পারতাম না। প্রথম দিনেই দেখি সদ্য রং করা দেওয়ালের এক কোনায় এক রাজনৈতিক পার্টির নামে রিজার্ভ করে ওরা লিখে রেখেছে অমুক পার্টি, অল ওয়াল, এত সাল থেকে অতো সাল।
যা বাবা!! এ কি মামার বাড়ি ? আমাদের বাড়ি, আমরা রং করাই, আমরা ট্যাক্স দিই আর লিখবে ওরা !!??কি করা যায়। ভাবতে ভাবতে একটা দাওয়াই বের করে ছিলাম। আমি খবরের কাগজে, নিচে লেখা বিজ্ঞাপণটা দিই। দাওয়াইটা তখন বেশ কাজে লেগেছিলো। পাঁচ বছর দেওয়ালে কেউ কিছু লেখেনি।
কিন্তু তারপর আবার যে কে সেই ! স্বভাব যায়না ম’লে!! কিন্তু মজার ব্যাপার ! যে পার্টি জোর-জবরদস্তি মাস্তানি দেখিয়ে লিখেছে, সেবার সে আমার অঞ্চলে ভোটে হেরেছে। পাড়ার লোকেরা তাদের সমর্থন করেন নি। চারদিকে তার পার্টি জিতলেও, আমাদের অঞ্চলে তিনি আঙ্গুল চুষেছেন।
সেই গড্ডালিকা প্রবাহ এখনো বহিতেছে।
এবার ভাবছি দাওয়াইটা আবার কাজে লাগিয়ে দেখবো কি হয়। তারপর সেই ছবি আপনাদের দেখাবো। নির্লজ্জ, দু-কান কাটাদের মধ্যে কোনোও পরিবর্তন হয়েছে কিনা।
দেখা যাক।
Be First to Comment