Press "Enter" to skip to content

ফিরোজা বেগমের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে গান শেখানোর জন্য পঙ্কজ মল্লিকের মতো শিল্পী তাঁর কলকাতার বাড়িতে চলে আসেন। গুণী শিল্পীরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ….।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ ফি রো জা বে গ ম

বাবলু ভট্টাচার্য : নজরুলসংগীতের কিংবদন্তি কিংবা উপমহাদেশীয় সংগীতের সম্রাজ্ঞী এমন অভিধা যাঁর ক্ষেত্রে অনায়াস প্রযোজ্য তিনি ফিরোজা বেগম।

ছোটবেলায় সব কিছুর মধ্যেও গান শোনার এক অদ্ভুত নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। পারিবারিক আবহে গান শেখার অবকাশ না থাকলেও বাবা-মায়ের সংগীতপ্রীতি ছিল। এটাই ছিল শুধু সহায়ক। বাসায় পেয়েছিলেন বেশ কিছু পুরনো রেকর্ড। পুরনো একটি কলের গানও ছিল। ফলে একাকী নিবিষ্টচিত্তে গান শোনার সুযোগ হয়। ক্রমাগত গানের নেশায় মত্ত হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু গান শেখার কোনো সুযোগ তো হচ্ছে না।

এক গ্রীষ্মের ছুটিতে ছোট মামা আর খুড়তুতো ভাইদের সঙ্গে গেলেন কলকাতায়। মামার উৎসাহে বোদ্ধামহলে গান শোনাতে লাগলেন। ছোট্ট মেয়েটার গায়কীতে মুগ্ধ সবাই। একদিন গুণীজনদের মজলিসে গান শুনিয়ে দারুণ তারিফ পেলেন। তাঁকে আদর করে পাশে বসালেন লম্বা চুলের এক ভদ্রলোক। গান শুনে জানতে চাইলেন, ‘এ গান তুমি শিখলে কেমন করে?’ তিনি জানালেন, ‘কালো কালো রেকর্ড শুনে নিজে নিজেই শিখেছি।’ শুনে তো সবাই অবাক। বাড়িতে ফিরে মামা জানালেন, আসরের মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনিই কথা বলেছিলেন তাঁর সঙ্গে। সে যাত্রায় কলকাতা ভ্রমণের এক অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে ফিরলেন ফরিদপুরে।

স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকতে না পারাটা তাঁর গান শেখার অন্তরায় হয়ে ওঠে। তবে যখনই কলকাতা যাচ্ছেন, নজরুলের সান্নিধ্যে গান শেখা হচ্ছে। এভাবেই কেটেছে তাঁর ছোটবেলার সোনাঝরা দিনগুলো।

১৯৪২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ইসলামী গান নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়। বিখ্যাত সুরসাধক চিত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে ছোট্ট ফিরোজা গাইলেন ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’। এতেই বাজিমাত। বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে সব রেকর্ড বিক্রি হয়ে যায়। সংগীতপ্রেমীদের সঙ্গে সুরের আকাশের এই তারার সেটাই প্রথম পরিচয়। ছোট্ট মেয়েটির গায়কী সংগীতবোদ্ধা ও সাধারণ শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।

কিছুদিন পর নতুন রেকর্ডের জন্য আবার চিঠি এলো। এবার হবে কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড। কীর্তিমান এই সুরকারের হাত ধরে বের হলো দ্বিতীয় রেকর্ড। গান ছিল- ‘ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাও’ আর ‘প্রীত শিখানে আয়া’।

এই রেকর্ড প্রকাশের মাধ্যমে সুরস্রষ্টার সঙ্গে শিল্পীর জীবনের অনন্য এক মেলবন্ধনের সূত্রপাত ঘটে— যা পরে পরিণয়ের দিকে গড়ায়। সে সময়ে সুযোগ হয় চিত্ত রায় ও কমল দাশগুপ্তের কাছে গান শেখার। বিশেষত কমল দাশগুপ্তের কাছে। জীবনের মূল শিক্ষাটাই পেয়েছেন ভারতবর্ষে ক্ষণজন্মা এই সুরকারের কাছ থেকে।

তত দিনে তিনি রবীন্দ্রসংগীত আর আধুনিক গানেও সমানভাবে বিখ্যাত। ফিরোজা বেগমের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে গান শেখানোর জন্য পঙ্কজ মল্লিকের মতো শিল্পী তাঁর কলকাতার বাড়িতে চলে আসেন। গুণী শিল্পীরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর তত্ত্বাবধানেও গানের রেকর্ড হলো। তখন ফিরোজা চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী। তবে নানা গানের ভিড়ে নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার এক তীব্র ইচ্ছা কাজ করে তাঁর মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিলেন অন্য গান নয়, নজরুলের গানই গাইবেন। নজরুলসংগীতই হয়ে উঠল তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন।

১৯৪৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁর কন্ঠে নজরুলের গানের প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করে— ‘আমি গগন গহনে সন্ধ্যাতারা…’ । ১৯৬০ সালে পুজো উপলক্ষে প্রকাশিত রেকর্ডে ফিরোজা গাইলেন সর্বকালের জনপ্রিয় দু’টি গান ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ আর ‘মোমের পুতুল’। ফিরোজার জনপ্রিয়তাকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।

১৯৪৮-৪৯ সালে ফিরোজা বেগম আর তালাত মাহমুদকে অতিথি শিল্পী হিসেবে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আর তাঁদের গানেই উদ্বোধন করা হয় ঢাকা রেডিওর শর্ট ওয়েভ। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ টানা ১৩ বছর ছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৬ সালে বিরলপ্রজ সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি তাঁর পরিবার। কিন্তু নিজের সত্যকেই তিনি সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

সারা বিশ্ব তিনি পরিভ্রমণ করেছেন নজরুলের গান নিয়ে। একক অনুষ্ঠান করেছেন ৩৮০টির মতো। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে তাঁকে নজরুলসংগীত ও অতুলপ্রসাদের গান শিখিয়েছেন ফিরোজা। এই আকাশছোঁয়া খ্যাতি তাঁকে কখনোই অহংকারী করে তোলেনি। খ্যাতিকে তিনি সব সময়ই নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছেন।

ফিরোজা বেগম সারা জীবন অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্বাধীনতা পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান ও বাংলাদেশে) প্রভৃতি।

তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন বাংলা ১৪০০ সালে কলকাতার সাহিত্যিক-শিল্পীদের দেওয়া সংবর্ধনা। সেবার ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’ শিরোনামে অসামান্য কন্ঠমাধুর্যের অধিকারী দুই শিল্পী নজরুলসংগীতের ফিরোজা বেগম ও রবীন্দ্রসংগীতের সুচিত্রা মিত্রকে সম্মান জানানো হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে সম্মাননা প্রদান করেছে।

৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

ফিরোজা বেগম ১৯৩০ সালের আজকের দিনে (২৮ জুলাই) ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

More from InternationalMore posts in International »
More from MusicMore posts in Music »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.