Press "Enter" to skip to content

প্রদীপের সঙ্গে আলাপ =প্রলাপ……..। (পর্ব=০৫১)

Spread the love


মঞ্চ-মায়াবী, জাদুশিল্পী পি সি সরকার, জুনিয়র
(Dr. Prodip Chandra Sorcar, M.Sc.,Ph.D.) কলকাতা, ৪ মার্চ, ২০২১। "এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি.." __গত পঞ্চাশ বছর ধরে, পৃথিবীর প্রায় সবকটি দেশেই আমি আমার ইন্দ্রজাল অনুষ্ঠান নিয়ে মেলে ধরেছি, ধরছি। সঙ্গে লট-বহর কম নয়, ডজন দুয়েক সহকারী এবং প্রায় চল্লিশ টন সাজসরঞ্জাম । আমরা শিল্পীরা যাই By Air, এবং মালপত্র যায় জাহাজে, ৪৫ ফুট লম্বা, কনটেইনারে করে। জাহাজ পৌঁছুবার কয়েকদিন আগে আমরা পৌঁছুই। তার আগে আমরা অন্য আর এক সেট মালপত্র নিয়ে অন্য জায়গায় শো করতে থাকি। ব'সে থাকা তো চলবে না। ওদিকে ওই অরগানাইজারেরা, জাহাজ থেকে কনটেইনার ছাড়িয়ে, থিয়েটার হলের ভেতর এনে রাখেন। আমাদের জন্য অপেক্ষা করেন। ওদের হল গুলোয় রাখার সে বন্দোবস্ত আছে। এখানকার মতো নয়। শিক্ষা- সংস্কৃতির উন্নয়ণ না হলে দেশের উন্নয়ণ হয়না। এঁরা সেটা জানে এবং মানে। সেজন্য সংস্কৃতিকে ভুল করেও, হেয় করে না। কিন্তু আমাদের এখানে? এখানে আমরা শিল্পীরা, মালপত্র কোথায় রাখবো, তার কোনও চিন্তাই নেই। অগ্রিম ভাড়া গুণে নিয়েই খালাস। ভাড়াটে-বাড়ি ওয়ালার সম্পর্ক। সেজন্য বিদেশ থেকে কোনো বড়মাপের অনুষ্ঠান এখানে আসে না। 'কচু বনে শেয়াল রাজা' হয়ে, নিজেকে নিজেই বাহবা দিয়ে, নির্লজ্জের মতো প্রচার করে চলেছে।

এখানে হলগুলো ভেঙ্গে, দিনকে দিন ছোট করা হচ্ছে। সীটের সংখ্যা কমাচ্ছে। আর ওখানে ওরা হল ভেঙ্গে, আরও বড় করে, তাতে সীটে সংখ্যা বাড়িয়ে, টিকিট সস্তা করার উপায় খুঁজছে, এবং নতুন প্রযুক্তি দিয়ে অনুষ্ঠানের উন্নয়ণ করাচ্ছে। এখানে তা নয়। বোঝেনা যে চিন্তাটা ‘বড়ো’ না রাখলে, বা কল্পনার আকাশটা বিশাল না হলে, নিজেদেরকেই ‘কূয়োর ব্যঙ’ হয়ে থাকতে হবে।
বুক ফুলিয়ে বলছি, এই মুহূর্তে আমাদের দল হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম, ভ্রাম্যমান মঞ্চশিল্পের ইন্ডাস্ট্রি। বিদেশে বলেন “LAST OF THE GREATS”. আমি এটা আরও বাড়াতে চাই। বিশ্বজুড়ে সর্বত্রই হবে আমার স্বপ্নের মতো বিশাল বিশাল সব ‘মহাজাতি সদন’। আমি তো আসলে বিশ্ব-নাগরিক। জাতে, ধর্মে, আদর্শে, শিক্ষায়, আমি একজন খাঁটি ভারতীয় জনতারই একজন। আমি, সিন্ধু-সভ্যতার গর্বিত উত্তরসূরী, পুরোদস্তুর আধুনিক সনাতনী হিন্দু, ‘গঙ্গা-রিডী’র একজন বাঙালি । আমি সব ধর্মকেই মানুষের মঙ্গলকামী ধর্ম হিসেবে শ্রদ্ধা করি। আমি ওই ‘মূত্রগণ্ডী’র স্বার্থপর রাজনীতিকে ভীষণ ঘেণ্ণা করি। বিদেশে, আমরা পৌছুলে তারপর সেই কনটেইনার খোলা হয়। কাস্টমস্ চেক হয়। তারপর আমরা মাল পত্র হাতে পাই এবং মঞ্চসজ্জার কাজ শুরু করি।

সাধারণতঃ চব্বিশ ঘণ্টা লাগে স্টেজ সাজাতে।
খুব ঝক্কির কাজ, কিন্তু গত পঞ্চাশ বছর , দিনের পর দিন করে করে, গা’য়ে সয়ে গেছে। কিন্তু এখানে, শো-এর মাত্র এক ঘণ্টা আগে হল খুলে, কাজ করতে দেওয়া হয়। বেশি সময় দেওয়া হয় যদি রাজনৈতিক দল গুলোর ব্যাপারে অনুষ্ঠানটা হয়। শিল্পীরা হন অবহেলিত। অপমানিত। বিদেশে, প্রায় সব দেশেই লম্বা একটানা অন্ততঃপক্ষে তিন সপ্তাহ প্রতিদিন শো করার দরুন, ওদের সাহিত্য, রূপকথা, জীবন-যাত্রার সঙ্গে, আমরা মিশে জড়িয়ে যাই। হোটেলে ফিরলে বলি, বাড়ি এলাম। হোটেলের রান্নাঘরে, ওরা আমাদের ভারতীয় রান্না করতে দেন। চুক্তিটা সেভাবেই করা থাকে। তার সুগন্ধে স্থানীয় সব মানুষ আমাদের বন্ধু হয়ে যান। স্যাম্পেল খেতে চান। এটা যে আমাদের দেশের পক্ষে, কতো বড় একটা প্রাপ্তি তা, অন্যেরা তো দূরের কথা, আমি নিজেও মেপে উঠতে পারি না। মানুষের মনে, হৃদয়ে, রসনায় জায়গা পাওয়া, এ যেন, দশ জন্মের আশীর্বাদ।‌ তাও আবার বিভিন্ন সংস্কৃতির, বিভিন্ন দেশ-বিদেশের মানুষের সাথে !! এভাবে এক জায়গায় ম্যাজিক দেখাবার পর, আমরা যখন অন্য দেশে, অন্য জায়গায় চলে যাই, তখন ভাবতেও ভালো লাগে, যে, আগের সব দেশের লোকেরা, তাঁদের নাতি -পুতিকে গল্প করে বলছেন বা বলবেন, "একজন না, জাদুকর এসেছিলেন। ভারতবর্ষের জাদুকর। তিনি চোখের সামনে একটা যাত্রী-ভর্তি রেল-গাড়িকে 'ফুঃ' ব'লে গায়েব করে দিতে পারতেন!" ওরা বিশ্বাসই করবে না। বলবে, "মিথ্যে কথা। সে আবার হয় নাকি?" তখন সেই দাদু বলবেন," না, না, মিথ্যে নয় ! আমি দেখেছি। তিনি না, একটা দুষ্টু মানুষকে সিংহ বানিয়ে বশ করে রাখতেন, খেলতেন, যেন ও একটা মেনি বেড়াল। একটা আস্তো হাতিকে হাত বুলিয়ে টগবগে ঘোড়া করে ফেলতে পারতেন, লম্বা মানুষকে পিটিয়ে পিটিয়ে বানাতে পারতেন পুঁচকে এই অ্যাত্তোটুকু একটা মানুষ। বাক্সে পুরে হেলিকপ্টার থেকে সাগরে ফেলে দিলে তিনি মুক্ত হয়ে আসতেন। চোখ বেঁধে সমাধান করতেন কঠিন কঠিন অঙ্ক !..." নাতি নাতনীরা বলবে, "সে কি !!! কি করে সম্ভব হতো ওগুলো ?" তখন সেই দাদু বলবেন, ভারতবর্ষ দেশটাই হচ্ছে অদ্ভুত! ওরা একদম অন্য রকম মানুষ। সুখে থাকার জাদু জানে। ওখানে গরিব মানুষেরাও কিছু না কিছু গয়না পড়েন। বন্ধুর সঙ্গে রেষ্টুরেন্টে খেলে, ওরাই দাম দিয়ে দ্যায়। বন্ধুকে দিতে দেয় না। খাওয়া দাওয়ায় সবাই সুস্বাদু মশলা ব্যবহার করে। কি সুন্দর তার গন্ধ আর স্বাদ, কি সুন্দর রঙের জামা-কাপড় ওরা গায়ে দেয়। ওদের দেশে ঝলমল করছে রোদ তারপর ঝমঝম করে বৃষ্টি। তারপর গাছ থেকে টপাট্টপ ফল পড়ে। বাচ্চারা কুড়িয়ে মজা করে। ওরা মাটি দিয়ে ঈশ্বরের মূর্তি বানিয়ে তাঁর সঙ্গে আত্মীয়তা পাতে। তাঁকে খুব সাজিয়ে পূজো করে । আবার পরে, সব সমেত জলে ফেলে দেয়। তাঁর সামনে খাবার সাজিয়ে আবার নিজেরাই খেয়ে নেয়!! কেঁদে বলে,"আবার এসো“!

ঠিক আমাদের মতো চিন্তা, ওদের নয়।” "ঐ জাদুকরের স্ত্রীও অনেক ম্যজিক জানতেন। তাঁর হাতে টাকা দিলে সেটা দ্বিগুণ হয়ে যেতো। মজা করে স্বামীকে তিনি কেটে দু-টুকরো করে ,''দুটো স্বামী' বানিয়ে নিতেন। তাঁদের মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে পুকুর, নদীর জলের ওপর দিয়ে পার হতে পারতো। রেস্টুরেণ্টে জায়গা না পেলে ,চায়ের কাপ হাওয়াতে ভাসিয়ে রেখে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে গল্প-গুজব করতো.." ইত্যাদি ইত্যাদি কতো দেশে কতো সব আজগুবি , মনগড়া গল্পের মতো । কিন্তু, অদ্ভুত ! সব সত্যি কথা ! কতো ভাষাতেই না লোকে তাদের বর্ণনা করে !! সব দেশই নাকি তাঁদের নিজেদের দেশ। সব মানুষই তাঁদের নাকি তাঁদের ভীষণ আপনজন । ওঁদের কথার ভীষণ দাম। শিল্পীরা শেষ নিঃশ্বাস ফেলা পর্যন্ত প্রাণ দিয়ে কাজ করেন, মারা গেলে তাঁর ছেলে এসে সেই কাজটা শেষ করে কথা রাখে.....ইত্যাদি।"

আসলে কিন্তু,” আমার কবিতা আমি জানি,
গেলেও বিচিত্র পথে,
হয় নাই সর্বত্রগামী।”
পৃথিবীর সবকটা দেশে গল্প হিসেবে পৌঁছুলেও, শারীরিকভাবে, স–ব দেশেই কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি।
বাবার চল্লিশ, আমার পঞ্চাশ আর মানেকার কুড়ি, সব মিলিয়ে একশো দশটা বছর, এই বিশাল পৃথিবীর কাছে খুবই কম একটা সময়। অ-নে-ক সুন্দর সুন্দর দেশেই যাওয়াই হয়নি। তবে হ্যাঁ, যে-সব দেশে আমার যাওয়া হয়নি, কথা দিচ্ছি , সেখানেও যাবো। ওদের এড়িয়ে, বাদ দিয়েছি তা নয়। আসলে সময়ে কুলোয় নি। তাঁদেরও রূপকথায় আমরা ভাগ বসাতে চাই। আমি যদি সময় করে উঠতে না পারি, তো আমার স্ত্রী, জয়শ্রী যাবে। জয়শ্রীর যদি উপায় না থাকে, তো আমাদের মেয়ে মানেকা, আমাদের হয়ে যাবে। ও যদি সময় না পায়, তো আমাদের আর দুই মেয়ে, মৌবনি আর মুমতাজ পালা করে যাবে। ওরা সব্বাই প্রস্তুতি নিয়ে আছে। আমার জাদু ওরা স–ব নিংড়ে শিখে নিয়েছে। ওরা নতুন নতুন ম্যাজিক নিয়ে যাবে। খুব জমিয়ে সেগুলো দেখাবে। আর ওদিকে ?…. আমি আর আমার বৌ, লুকিয়ে লুকিয়ে চুপচাপ পা টিপে টিপে বেড়াতে যাবো সেখানে, গল্প শুনতে, সবাই কেমন মজা করছেন, দেখতে। ওঁদের দেশের খাবার খাবো। বেড়াবো।ওঁদের মতো সাজবো। খুব মজা হবে।

এতো দেশে গেছি, সব্বাই জিজ্ঞেস করেন, কোন দেশটা আপনার সব চেয়ে বেশি ভালো লেগেছে? আমি এর জবাবে এতো দিন যা বলে এসেছি, এখনও তাই বলি। মত পাল্টাই নি।
আমি বলেছি, “এক-একটা ব্যাপারে এক একটা দেশ হচ্ছে সেরা। প্রয়োজন বুঝে আমার সেই দেশটাকে ভালো লাগে। এই যেমন, যদি ইলেকট্রনিক কিছু পেতে চাই, তো আমি জাপানে যাবো। টোকিওর “আকিহাবারা” অঞ্চলে । সেখানে আধুনিক স–ব কিছু আছে। দুর্দান্ত সব ভাবনা! যদি উন্নত বিজ্ঞান ভিত্তিক যান্ত্রিক কিছু কিনতে বা পেতে চাই, তবে জার্মানী যাবো। যদি কাঁচের তৈরি ঝলমলে কিছু কিনতে চাই, তাহলে বেলজিয়াম যাবো। যদি হাল ফ্যাশানে, সেজে স্টাইল করে চলতে চাই, তো পোল্যান্ড যাবো । যদি নিশ্চিন্তে হাসপাতালে চিকিৎসার দরকার হয়, তো রাশিয়া যাবো। যদি লেখাপড়া করতে চাই, তো ইংল্যান্ড যাবো ! যদি পারফিউম বা সেরা ওয়াইন পেতে চাই, তো ফ্রান্সে যাবো, যদি হৈ-হুল্লোড় করে ফুটানি মারতে চাই, তো অ্যামেরিকা যাবো। যদি চূড়ান্ত ধর্মবিশ্বাসী দেশ দেখতে চাই, তো আরবে যাবো। যদি কায়িক পরিশ্রমের শিল্প কীর্তি দেখতে চাই, তো মিশরে যাবো।

জীবজন্তু দেখতে কেনিয়ায় যাবো। যদি সস্তায় মণিহারী জিনিষ কিনতে চাই, তো চিন দেশে যাবো । যদি চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সব চেটেপুটে খেয়ে, ঢেকুর তুলে, ভাত-ঘুম দিতে চাই, তো সোজা চলুন, বাংলাদেশে যাবো। আর হ্যাঁ, যদি…….বৌ, বাচ্চা, নাতি-পুতি, জ্যাঠা-জ্যেঠিমা, বাবা-মা, মামা-মামী, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে, মিস্টি দই, পাটালি গুড়ের পায়েস, ফুচকা, বা নিদেন পক্ষে আধপেটা ‘ডিম্ভাত’ খেয়েও শুধু শুধু মিছিলে গিয়ে, সব সময় “ভালোই আছি” বলে বাঁচতে চান, তো ভারতবর্ষ হচ্ছে বেস্ট। কোনো লোক দেখানো ন্যাকামীর বালাই নেই । তুমি যা, তুমি তাই-ই। কেউ পরোয়া করে না। তুমি লুঙ্গি পড়ো বা ধুতি পরো, কেউ খেয়াল করবে না। কিন্তু যদি স্যুট-বুট পরো, তো ব্যস্ ,সবাই একটু এড়িয়ে যাবে। এটা স-ব ভালো ,’মানিয়ে নাও’, অহেতুক প্রশ্ন-“ক্যামন আছেন?”এর দেশ। সবাই এখানে সব সময়েই , “ভালো আছি” বলেন । সবাই নিশ্চিন্ত !
আসলে, এখানে ফেরা, যেন মায়ের কাছেই ফেরা। লোক দেখানো ভড়ং না করে, মায়ের আঁচলে মুখ মোছায় যে কি শান্তি আর নিশ্চিন্তি, তা অন্য কোথাও নেই। কোনোও সুন্দরী মেমসাহেবের গন্ধ-রুমালই, এখানে পাত্তা পাবেনা। এটার স্বাদ যে পায়নি, সত্যিই তার কপাল খারাপ। আমাদের দেশ ভালোবাসার দেশ। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ। “ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে।”
সেজন্য সমঝদারেরা বেড়াতে এসে এখানে থেকে যান। সবাই খুঁত ধরেন। কিন্তু আবার কি-যেন কিসের টানে, ফিরে ফিরে আসেন। থেকে যান। “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি !”

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.