ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। কলকাতা, ১৮, ডিসেম্বর, ২০২০। আমি যখন সত্যি-সত্যি জুনিয়র ছিলাম, তখন পৃথিবীটা ছিলো একদম অন্যরকম । এ-বাড়ি ও-বাড়িতে সন্ধেবেলায় শাঁখ বাজতো। আমাদের বাড়িতে আমাকেই বাজাতে হতো প্রায় প্রতিদিন। সেজন্য সময় মতো বাড়ি ফিরতেই হতো। মা ধুনুচি জ্বালিয়ে ধূনো দিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিতেন। আমি এ-ঘর ও-ঘর ঘুরতাম। পাড়ার মাখন বাবুদের বাড়ির ওপাশ থেকে হারমোনিয়ামের রিড্ কে ছাপিয়ে গলা সাধতো একটা মেয়ে। নাম জানলাম, মা আর মাসীর কথায়। ওর নাম পুতুল বিশ্বাস, কম্পিটিশনে খেয়াল গেয়ে ফার্স্ট হয়ে সোণার মেডেল পেয়েছে। খবরের কাগজে নাম ছেপেছে। এ পাশে কোনো একটা বাড়িতে কেউবা পড়া মুখস্থ করতে শুরু করেছে জোরে জোরে। পাড়ার মোড়ের গ্যাসের লাইটটা কে যেন একজন মৈ নিয়ে এসে রোজ জ্বালিয়ে যান। কারুর সঙ্গে কথা বলেন না। বেশ কয়েক বছর পর ওটা পাল্টে ওই ল্যাম্প পোস্টেই ইলেকট্রিকের বাল্ব বসলো।সেই মৈ আনা লোকটা আর আসেনা। লাইট কিন্তু সময়মতো জ্বলে আর নেভে। রাতে হঠাৎ করে লোড শেডিং হলে প্রতিটা বাড়ির থেকে সমস্বরে ‘হো’ করে একটা আওয়াজ সৃষ্টি হতো। আমরা মজা পেতাম। মোমবাতি জ্বালিয়ে কালীপূজোর পরিবেশ। মনখারাপের অভিনয় করে বলতাম ” ধ্যুশ্ এর মধ্যে কি আর লেখাপড়া করা যায়?” বই খাতা ভাঁজ করে রেখে বলতাম “পড়বো না”।
রসভঙ্গ করে দিতেন ঠাকুমা। বলতেন,”দেশ- বাড়িতেও ইলেকট্রিক ছিলো না। কুপি জ্বলাইয়াই আমরা রাত কাটাই ছি। তোমার বাবা এই ভাবেই লেখাপড়া কইরা ফার্স্ট হইছে। “
সত্যিই তাই। বাবা আমাদের বলতেন,”- আমরা খুব দরিদ্র ছিলাম। পাড়ার সব্জী-প্রতিযোগীতায় আমাদের ফুলকপি ফার্সট্ হয়। প্রাইজ ছিলো একটা লণ্ঠন। সরকার বাড়িতে এই প্রথম নিজস্ব লণ্ঠনের স্থির আলো, সেটা বাড়ানো-কমানো, দমকা হাওয়াকে তোয়াক্কা না করার পারিবারিক অভিজাত্য এবং বিলাস প্রকাশ পায়।
শুনে আমরা ওই মোমবাতির আলোতেই পড়তে বসে যাই। পরবর্তীকালে যখন পড়ার বই খুলে সেদিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে ম্যাজিকের কল্পনায়, মায়ার জগতে ডুবে যেতাম, এবং সেই নিমজ্জমান ‘জহর’কে কান ধরে টেনে ডাঙ্গায় তুলে প্রাণে বাঁচাতেন আমার চরম আতঙ্ক, আমার পরম শ্রদ্ধেয় -‘বাড়ির বাবা’ -গম্ভীর পি সি সরকার । তখন চুপচাপ দোষ স্বীকার করা ছাড়া জহরের আর কোনো পথ থাকতো না।
ও হ্যাঁ, ‘জহর’-এর সঙ্গে তো আপনাদের আলাপ, পরিচয়ই করিয়ে দেওয়া হয় নি। জহর হচ্ছে প্রচণ্ড ফচকে, ফাঁকিবাজ, মিটমিটে শয়তান, প্রতিহিংসা পরায়ন,ন্যাকা, ‘আমি’ নামক একটা কচি কবির ডাকনাম। একদম আলাদা ওর চরিত্র। এমনিতে দেখে বোঝা যায় না, ও পেটে পেটে কি ভাবছে। আগে বলা ওই পরিস্থিতির সম্পর্কে জহর কবি পরবর্তীকালে একটা স্মৃতি-কবিতা লিখেওছে:-
“বাল্যস্মৃতি”
যখন আমি ছোট্টো ক্লাসে পড়ি,
একদিন বাবা ডেকে বললেন মোরে,
“পড়ো জোরে জোরে,”….
। ইত্যাদি ।
সেই জহরকে লেখাপড়া শেখাতেই হবে। বাবা শেষে পাড়ার বেস্ট কনসালট্যান্ট “রূপ-পরিবর্তন হেয়ার কাটিং সেলুন”-এর মালিক সুধীর বাবুর কাছে সারেণ্ডার করেন। বলেন, যে করেই হোক একটা চালাক চতুর গৃহশিক্ষক যোগার করে দাও ভাই। যাতে ছলে বলে কৌশলে পড়াশোনাটা উৎড়ে দেয়।
মাস্টার মশাই এলেন। লম্বা চওড়া কিন্তু কুচুটে প্রকৃতির লোক। বাবার পছন্দের মানুষ। জহর ভয় পেয়ে যায়। পড়া শুরু হয়। শুরুতেই আমি ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে চেয়ারে বসি। মাস্টার মশাই মুখ ভুরু কুঁচকে বলেন,”এ্ঃ একেবারে তৈরি ছেলে।” জহর মনে মনে বলে, “সাবধানে খেলতে হবে…ঘাগু মাস্টার!!”। উনি হোম টাস্ক দেন, করে রাখি। না করলে আঙ্গুলের ফাঁকে পেন্সিল রেখে পাশ থেকে চাপ দেন। আমার ভীষণ ব্যথা লাগতো। বলতেন “এর পর কথা না শুনলে আরও জোরে চাপবো।”
আমি ঠিক বাগে পাচ্ছি না। কিন্তু ভগবান তো আছেন মাথার ওপর। তিনিই পথ করে দেন।
কয়েকদিনের মধ্যেই খেয়াল করি, আমার ছোট মাসী যখন ওই পড়ার ঘরে অন্য কোনও কাজে আসে তখন মাস্টার মশাই একটু আড়ষ্ট হয়ে ইংরিজিতে কথা শুরু করে দেন। মাসী চলে গেলেই আবার নরম বাঙালি হয়ে যান। এটা আমি খেয়াল করেছি। ভগবান কে বলি,” তোমার অসীম কৃপা। আমি পথ পেয়েছি।”
পরের দিন স্যারকে বলি,”কালকে আপনি যে নীল শার্ট টা পরেছিলেন ওটাতে আপনাকে খুব সুন্দর মানিয়েছিল।”
মাস্টার মশাই ধমকে রেগে ওঠেন। বলেন,”ক্লাস সিক্সের ছেলে,। খুব পেকেছো। হোম টাস্ক করেছো?” আমি ঘাড় কাত করে বলি,”হ্যাঁ, সব”। স্যারকে খাতা দিতে দিতে বলি,”আমি না, আমার মাসী বলছিলো..”
উনি স্তব্ধ।
কিছুক্ষণ পরে বললেন,” কী বলছিলো , what ?”
আমি বানিয়ে আরও অনেক কথা বলি।অনেকক্ষণ পরে উনি বলেন, “তোমার মাসীকে বলো, ও যা পরে, সবেতেই beautiful লাগে।”
-“বলবো”।
মাসী, সাত দিনের জন্য আমাদের বাড়ি এসেছিলো। বেচারা, কিছুই জানে না। বাড়ি ফিরে গেছে। স্যারকে সেকথা বলিনি। আর উনিও আঙ্গুলে ব্যাথা দেননি। রোজ নীল শার্ট পরে এসে আমাকে যত্ন নিয়ে পড়িয়েছেন। আমি পাশ করেছি।
ওনার নামটা প্রকাশ করলাম না। দূর থেকেই গুরু-প্রণাম করলাম। জহর খুব পক্কো ছেলে, সেজন্য ওই নীল শার্ট টাকেও প্রণাম করলাম। আমার শিক্ষা-দীক্ষায় ওই নীল শার্টের অবদান অ-নে-ক।
Be First to Comment